Monday 24 June 2013

সিজোফ্রনিয়া রোগী: মিরপুরের রিতা-মিতা ফের বগুড়ায় উদ্ধার

মানুষের মানসিক অসুস্খতা বা মানসিক ব্যাধি প্রকৃতি অনুসারে দুই জাতের হতে পারে। এদের কতক মৃদু মাত্রার, আবার কতক তীব্র মাত্রার। সিজোফ্রনিয়া একটি তীব্র মাত্রার জটিল মানসিক ব্যাধি।
সিজোফ্রনিকরা নিজস্ব ভুবন তৈরি করে নেয়, যার মাঝে বাস্তবতার লেশমাত্র নেই। বাস্তবতার সাথে তাদের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি আর বোধশক্তির এত বেশি ফারাকের জন্যই এটিকে আমরা সাইকোসিস বলে থাকি। সাইকোটিক রোগীরা তারা নিজেরা যে অসুস্খ সেটি পর্যন্ত বুঝতে পারে না। 
সিজোফ্রনিয়ার উপসর্গ হ্যালুসিনেশন বা অলীক শ্রবণ
সিজোফ্রনিয়া রোগীদের অনুভূতি বা ইন্দ্রিয় স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি শাণিত ও তীক্ষîরূপ ধারণ করে। যেসব তথ্য পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্যে মস্তিষ্কে পৌঁছায়, মস্তিষ্কে এক্ষেত্রে সেসব তথ্যকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ-ব্যাখ্যা করতে পারে না। 

সিজোফ্রনিয়াকরা  গায়েবি আওয়াজ শুনতে পান যে, তাকে বলা হচ্ছে ‘তুমি এটা কর ওটা কর’। অথচ আশপাশে কেউ নেই বা আশপাশে কেউ সিজোফ্রনিয়াতে যারা অনেক দিন যাবৎ ভোগে তারা ক্রমশ সমাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিজস্ব মনের ছোট গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ভুবনে থাকতে পছন্দ করে। এটি অবসন্নতা বা বিষণíভাবের জন্য হতে পারে অথবা একা থাকাটাই নিরাপদ­এ রকম ভ্রান্ত ধারণার কারণেও হতে পারে। সমাজে বসবাসের জন্য আচরণগত যেসব দিক থাকা দরকার তা অনেক সিজোফ্রনিয়ার থাকে না। 

এ রকম সিজোফ্রনিয়া রোগীই হলেন এরা দুবোন।
ঢাকার মিরপুরের বহুল আলোচিত সেই ‘ভূতের বাড়ি’র বাসিন্দা দুই বোন ডা. আইনুন্নাহার রিতা ও প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতা এখন উত্তরের শহর বগুড়ায়। তারা গত চার মাস শহরের একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছিলেন। এক সপ্তাহ ভাড়া পরিশোধ না করা ও দু’দিন না খেয়ে তারা হোটেল কক্ষের দরজা বন্ধ করে থাকায় হোটেলের লোকজন পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। রোববার দুপুরে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এক সদস্য ও পুলিশ তাদের অনেক কষ্টে উদ্ধার করেন। পরে তাদের শহরতলির বারপুরে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে ডা. রিতা অসুস্থ। তিনি কোন কথা বলেননি। ‘আমরা বাংলাদেশের মালিক, শত্র“রা তাদের সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। দেশ দোজখ হয়ে গেছে। আল্লাহর নির্দেশে বগুড়ায় এসেছেন। নির্দেশ পেলেই আবার এখান থেকে কানাডা ফিরে যাবেন।’ প্রকৌশলী মিতা এমন অনেক অসংলগ্ন ও আধ্যত্মিক কথা বলেন।
বগুড়া সদর থানা সংলগ্ন আকবরিয়া আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার লিটনুর রহমান জানান, ২০ ফেব্র“য়ারি রাত ১১টার দিকে দু’জন নারী রাত্রি যাপনের জন্য আসেন। খাতায় তারা একজন ডা. আইনুন্নাহার ও অন্যজন প্রকৌশলী নুরুন্নাহার নাম লেখেন। বাবার নাম লেখেন মৃত সরফ উদ্দিন। ঠিকানা লেখা হয় বি.বাড়িয়ার নাসিমনগরের মণ্ডলগ্রাম। তারা প্রায় চার মাস আবাসিক হোটেলের ২১ নম্বর রুমে থাকেন। হোটেলেই খাওয়া-দাওয়া করতেন ও রীতিমতো বাইরে বেড়াতে যেতেন। এ সময় তারা ভাড়া পরিশোধ করেছেন। ম্যানেজার আরও জানান, এক সপ্তাহ ধরে তারা হোটেল ভাড়া বন্ধ করে দেন। গত দু’দিন ধরে ঘর থেকে বের হন না। খাওয়া-দাওয়া করেননি। বিষয়টি সদর থানার পুলিশকে অবহিত করা হয়। রোববার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে পুলিশ ও আইনজীবীরা তাদের দু’বোনকে নিয়ে যান।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সদস্য অ্যাডভোকেট শাহজাদী লায়লা জানান, রোববার দুপুরে সদর থানা পুলিশ তাকে বিষয়টি জানালে তিনি প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর পুলিশের সহযোগিতায় শহরে থানা রোডের আকবরিয়া আবাসিক হোটেল থেকে ডা. রিতা ও প্রকৌশলী মিতাকে অনেক কষ্টে উদ্ধার করেন। প্রথমে তারা দরজা খুলতে রাজি হননি। পরে তাদের অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দরজা খুলতে রাজি করানো হয়। উদ্ধারের পর আপাতত তাদের শহরতলির বারপুরে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দে রাখা হয়েছে।
সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দে র ব্যবস্থাপক আবদুল মানিক জানান, আপাতত দুই বোন ডা. রিতা ও প্রকৌশলী মিতাকে এখানে রাখা হবে। পরে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি তাদের ঢাকায় নিয়ে যাবেন। কেন্দে র কাউন্সিলর ইসমত আরা জানান, দু’বোন তাদের বাবার নাম হাবিবুর রহমান চৌধুরী বলেছেন। বাড়ির ঠিকানা দিয়েছেন, মিরপুর ৬ নম্বর, ঢাকা। তারা নিজেদের নাম বেশ কয়েকটি বলেছেন। তিনি জানান, দুই বোন দুপুরে আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেল থেকে দেয়া মোরগ পোলাও খেয়েছেন। এদের মধ্যে ডা. রিতা কিছুটা অসুস্থ। তিনি খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছেন। কথা বলতে চান না।
ঢাকার মিরপুরের আলোচিত দুই বোন ডা. রিতা ও প্রকৌশলী মিতার উদ্ধারের খবর পেয়ে শহরতলির বারপুরে সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দে গেলে প্রথমে তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
পরে প্রকৌশলী মিতা কেন্দে র কর্মকর্তা ও সাংবাদিকদের বলেন, ‘তারা দু’বোন বাংলাদেশের মালিক। বাংলাদেশ দোজখ হয়ে গেছে। আল্লাহর নির্দেশে তারা কানাডা থেকে বগুড়ায় এসেছেন। তারা এখনও যুদ্ধ করছেন। শত্র“রা তাদের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। মিরপুরের বাড়ি উৎসর্গ করা হয়েছে। আল্লাহর নির্দেশ পেলেই তারা আবারও কানাডায় ফিরে যাবেন।’ এমন অনেক আধ্যাÍিক ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেন তারা। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র সদস্য অ্যাডভোকেট শাহাজাদী বলেন, কিছুদিন দুই বোন ওই কেন্দে ই থাকবেন। সমিতির নেতৃবৃন্দকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। পরে তাদের ঢাকায় নেয়া হবে।
  http://www.jugantor.com/last-page/2013/06/24/7641

দুই বছর আগে রাজধানীর মিরপুরের একটি বাসা থেকে উদ্ধার করা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত দুই বোন রিতা-মিতাকে ফের বগুড়ার আকবরিয়া হোটেল থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। সেখানে চিকিৎসক আইনুন্নাহার রিতা (৪৯) সারা ফেরদৌস জয়ী পরিচয়ে এবং প্রকৌশলী নুরুন্নাহার মিতা (৪৫) সারা ফেরদৌস সুজানা পরিচয়ে টানা চার মাস অবস্হান করছিলেন। গতকাল দুপুরে উদ্ধারের পর তাদেরকে জেলার সামাজিক প্রতিবন্ধী মেয়েদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

উদ্ধারের সময় দুই বোন হোটেল ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না। তাদের কয়েকদিনের হোটেল ভাড়াও বাকি ছিল। পুলিশকে তারা বলেন, আমরা আল্লাহর লোক। আমরা আবাসিকের ভাড়া কেন দেব? এই ভবন আমাদের। আল্লাহ আমাদের চলে যেতে বললে আমরা চলে যাব। আমরা আল্লাহর নির্দেশে আছি। 

পুলিশ জানায়, গত ২০ ফেব্র“য়ারি আকবরিয়া আবাসিক হোটেলের ৩য় তলার ২১ নম্বর রুমে ওঠেন। ওই রুম থেকে তারা দিনের বেলায় কোথাও চলাচল করতেন না। প্রতিদিন সন্ধ্যায় খাবার নেওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়ে আধাঘণ্টা পর আবার রুমে ফিরতেন। আবাসিকে অব¯'ানকালে তারা পর্দানশীল ছিলেন। সবসময় আল্লাহর নাম নিতেন। আবাসিকে নিজেদের নাম নুরুন্নাহার ও আইনুন্নাহার বলে উল্লেখ করেছেন। তাদের পিতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মৃত ফরুখ উদ্দিন। ঠিকানা দিয়েছেন মণ্ডল পাড়া, নাছির নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ওই রুমের ভাড়া দিতেন ৬০০ টাকা করে। গত প্রায় ১০ দিন আবাসিকের ভাড়া প্রদান না করায় গত শনিবার হোটেল কর্তৃপক্ষ থানা-পুলিশকে জানায়। পুলিশ রোববার তাদের উদ্ধার করে এবং পরে তাদের প্রতিবন্ধি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রেরণ করে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তারা আবাসিকে থেকে গত চার মাসে ভাড়া পরিশোধ করেছেন প্রায় ৭২ হাজার টাকা। এ ছাড়াও তারা বাইরে থেকে খাবার কিনে খেয়েছে। তারা এত টাকা পেতেন কোথায়? 

আকবরিয়া আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার দিবাকর দাস দিপু জানান, আবাসিকে তারা অবস্হানকালে তাদের সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসেনি। পানি ছাড়া আবাসিকের কোনো খাবার খেতেন না। সন্ধ্যার পর বাইরে যেতেন এবং প্রায় আধাঘণ্টা পর খাবার নিয়ে এসে খেতেন। তাদের আচরণ রহস্যজনক বা আধ্যাত্মিক ছিল। তারা সবসময় একসঙ্গে চলাচল করতেন। তারা গত চার মাসে হোটেলে অবস্হান করে নিয়মিত টাকা পরিশোধ করলেও গত ১০ দিনের মত ভাড়া পরিশোধ করেননি। ভাড়া পরিশোধের জন্য বলা হলে তারা ধর্মীয়ভাবে রহস্যজনক কথা বলতেন। পরে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। 

বগুড়া সদর থানার উপ পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন জানান, উদ্ধার করতে গেলে তারা বলেন যে, আল্লাহর সঙ্গে আগে কথা বলি তারপর আপনাদের সঙ্গে যাব। পরে তাদেরকে প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে উদ্ধার করা হয়। তাদের কথা রহস্যজনক। মানসিক ভারসাম্যহীন বলেও ধারণা করা হচ্ছে। কোথা থেকে এসেছে বললে তারা বলে যে, আল্লাহর নির্দেশে এসেছে। আল্লাহ তাদের নির্দেশ দিলে চলে যাবে। দেশের সব মানুষের ফাঁসি হয়েছে। তারা দুই বোন ছাড়া আর কেউ দেশে থাকবে না। 

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে রিতা ও মিতাকে তাদের মিরপুরের বাসা থেকে অসুস্হ্য অবস্হায় উদ্ধার করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্হ্য  হয়ে তারা বাড়ি ফেরেন। সেসময় কিছুদিন বড়বোন কামরুননাহার হেনার সঙ্গে থাকলেও পরে তারা আলাদা বাসায় থাকতে শুরু করেন। এর আগে ২০০৭ সালেও একই কারণে তারা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে আবার তারা অসুস্হ্য হয়ে পড়েন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সিজোফ্রেনিয়া একটি মারাত্মক মানসিক সমস্যা যেখানে মানুষ বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায় এবং অবাস্তব অনেক কিছুকে বাস্তব হিসেবে বিশ্বাস করে। এই সমস্যা দীর্ঘমেয়াদি এবং ধারাবাহিক চিকিৎসায় কমলেও তা বারবার ফিরে আসতে পারে। 
http://www.amadershomoy1.com/content/2013/06/24/news0327.htm

No comments:

Post a Comment