Sunday 11 August 2013

মানসিক রোগ চিকিৎসায় সাধারণের দৃষ্টিভঙ্গি

মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসার প্রতি ভ্রান্ত ধারণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের দেশেও বিদ্যমান। পঞ্চাশ দশকের শুরুর দিকে যখন মানসিক রোগ চিকিৎসার আধুনিক ঔষধ আবিষ্ককৃত হয় তখন মানসিক রোগ চিকিৎসায় বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা তৈরি হয়। কিন্তু এ উৎসাহ বেশীদিন স্থায়ী হয়নি জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। 
কালের পরিক্রমায় মানসিক রোগ চিকিৎসার অগ্রগতি হলেও জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির কাঙ্খিত পরিবর্তন সাধিত হয়নি। অথচ মানসিক রোগ চিকিৎসার বর্তমান অগ্রগতি এক কথায় বিস্ময়কর । আমাদের দেশে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার তুলনায় মানসিক রোগ চিকিৎসায় উন্নতি বেশি যুগোপযোগী। উন্নত দেশে মানসিক রোগচিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধের শতকরা ৯৯ ভাগ এদেশে তৈরি হয় যা মনোচিকিৎসকগণ সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করছেন । তারপরও এ সব অতি প্রয়োজনীয় ঔষধ সম্পর্কে জনগণ, এমনকি চিকিৎসক ও মনোবিদদের রয়েছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার। এ বিষয়টি মানসিক রোগ চিকিৎসার অন্যতম অন্তরায়। 


সাধারণ জনগণের বেশিরভাগের ধারণা মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধগুলি শুধুমাত্র ঘুমের জন্য ও উপসর্গ দূর করার কাজে লাগে, প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে পারেনা। অনেকের ধারণা এসব ঔষধে আসক্তি তৈরি হয়। কিন্তু শুধুমাত্র বেনজোডায়াজেপিন গ্রুপের ঔষধ (যা উদ্বেগ ও অনিদ্রা সমস্যার জন্য ব্যবহার করা হয়) দীর্ঘমেয়াদে ব্যবহার করলে আসক্তির সমস্যা দেখা যায়। বিষন্নতারোধী ও জটিল মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত অন্যান্য ঔষধে এ ধরনের সমস্যার কোন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই। জনগণের মধ্যে অন্যসব মানসিক রোগের ঔষধের প্রতি এ ভ্রান্ত ধারণার সরলীকরণ করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে রোগীরা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদীন এ ধরণের ঔষধ (বেনজোডায়াজেপিন) সেবন করলে কিংবা চিকিৎসকের অজ্ঞতার কারণে দীর্ঘ দিন ব্যবহারে এ সমস্যা নিয়ে রোগীরা মনোচিকিৎসক ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের (Psychitrist) শরণাপন্ন হন, তখন বিষন্নতারোধী ঔষধ দিয়েই এ রোগের চিকিৎসা করা হয় ! 

পরিচিত কয়েকজন চিকিৎসকের কথা জানি যারা নিজেদের ও তাদের সন্তানদের মানসিক রোগ চিকিৎসায় ঔষধ সেবন করতে চাননা শুধুমাত্র নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তারা মনোচিকিৎসকের কাছে ঔষধ ব্যতীত সাইকোথেরাপী ও কাউন্সিলিং (মনোসামাজিক চিকিৎসা) দাবী করেন। কিন্তু তাদের জানা থাকা প্রয়োজন, মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের মূল দায়িত্ব মানসিক রোগ নির্ণয় করে প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধসহ, মনোসামাজিক চিকিৎসা ও অন্যান্য পরামর্শ প্রদান এবং প্রযোজন অনুসারে সাইকোথেরাপীর জন্য মনোবিদের (Psychologist) নিকট রেফার করা । অন্য চিকিৎসকদের যখন এ অবস্থা তখন জনগনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আলোচনা হতাশাজনক মনে হতে পারে। আবার, বেশীরভাগ জনগণ ও চিকিৎসক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও মনোবিদের পার্থক্য বোঝেন না । এজন্য টিভি টকশোতে প্রায়ই মনোবিদকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ।  সবচেয়ে দুঃখজনক এ ধরনের অনুষ্ঠানে মানসিক রোগের ঔষধ (বিষন্নতারোধী) সম্পর্কে যে ধরনের নেতিবাচক, বিভ্রান্তিকর ও অবৈজ্ঞানিক তথ্য পরিবেশন করা হয় তা অজ্ঞানতার অপরাধে দুষ্ট। এতে ঔষধ সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি আরও বাড়ে যা মানসিক রোগচিকিৎসার প্রধান বাধা। কোন ধরনের মানসিক রোগে কোন ধরনের চিকিৎসা (ঔষধ ও মনোসামাজিক চিকিৎসা) অত্যাবশক তার বিজ্ঞানভিত্তিক (Evidence Based) দিক নির্দেশনা রয়েছে। সস্তা জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য যার যে বিষয়ে জ্ঞান নেই তার সে বিষয়ে বলা অনৈতিক। 
জটিল ও তীব্র মানসিক রোগ যেমন স্কিটজোফ্রিনিয়া, ম্যানিয়া ও অন্যান্য সাইকোটিক ডিজঅর্ডার (যেখানে রোগীর বাস্তবতার সাথে কোন সংযোগ থাকে না) এবং নিউরোটিক সমস্যা যেমন মাঝারি থেকে তীব্র বিষন্নতা, অবশেসন, শিশুদের অতিচঞ্চলতা (ADHD) প্রভৃতি বিভিন্ন মানসিক রোগ চিকিৎসায় ঔষধের কোন বিকল্প নেই । কারণ এ সব রোগে মস্তিস্কের বিভিন্ন রাসায়নিকের (Neurotransmitter) পরিবর্তন ঘটে যা ঔষধ ব্যতীত মনোসামাজিক চিকিৎসায় পরিবর্তন সম্ভব নয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণ জনগণ এসব মানসিক রোগে ঔষদের চেয়ে মনোসামজিক চিকিৎসাকে বেশি প্রয়োজনীয় ভাবেন ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। জার্মানীর এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্কিটজোফ্রিনিয়া নামক জটিল মানসিক রোগে শতকরা ৭৬ ভাগ লোক সাইকোথেরাপিকে এবং মাত্র ৮ ভাগ ঔষধকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করেন। 
চিকিৎসক ও চিকিৎসা শিক্ষানবিসদের মধ্যেও মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। অনেকসময় চিকিৎসকগণ মনোচিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই না বুঝে মানসিক রোগের ঔষধ বন্ধ করে দেন । এতে উক্ত রোগীর মানসিক ও শারীরিক উভয় রোগের চিকিৎসা জটিলতা বৃদ্ধি পায়। যেমন, ডায়াবেটিস রোগীর বিষন্নতা থাকলে তার চিকিৎসা না হলে বিষন্নতার কারণে তার ডায়াবেটিস চিকিৎসার প্রতি অনীহা, খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম কর্মসূচী ব্যাহত হয় এবং এতে রক্তের সুগার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। আবার অনেকের ধারণা শিশুদের মানসিক রোগের ঔষধ মস্তিস্কের ক্ষতি সাধন করে। তাহলে তো শিশুর স্নায়ুরোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত সকল ঔষধের ব্যবহার বন্ধ রাখতে হয় কারণ এসব ঔষধ পুরোপুরি শিশুর ব্রেইনের উপর কাজ করে। কিন্তু তা কি বাস্তবসম্মত ? চিকিৎসা শিক্ষানবিসদের উপর এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র শতকরা ৪০ জন মনে করে শিশু মানসিক রোগে ঔষধ ব্যবহার করা যায়।  বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ গ্যালারীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে শ্রদ্ধেয় একজন অধ্যাপক ও শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ তার বক্তৃতা শুরু করেন এভাবে “ পাগল হচ্ছে দুই প্রকার- বড় পাগল ও ছোট পাগল (তিনি অটিস্টিক শিশুকে বোঝাচ্ছেন); বড় পাগলের চিকিৎসা সহজ, কিন্তু ছোট পাগলের কঠিন”। আমি তো তার কথা শুনে হতভ এই হচ্ছে মানসিক রোগের 
এই হচ্ছে মানসিক রোগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির নমুনা। আর অটিজম মানসিক রোগ না– এ বিষয়ে তাদের প্রচার ক্লান্তিহীন। এতে অটিস্টিক শিশুর কী উপকার হচ্ছে তা আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু এটুকু বুঝি মানসিক রোগ হওয়াটা যে একটি সামাজিক কলঙ্ক- এ বর্বর চিন্তা-ভাবনা থেকে তাদের মত তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরাও বেড়িয়ে আসতে পারেননি। যদিও অটিজম একটি স্নায়বিক বিকাশজনিত সমস্যা (Neurodevolpmental), তাদের শিশু মানসিকরোগ হওয়ার সম্ভাবনা অন্য শিশুদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এ জন্য তাদের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সহায়তার প্রয়োজন হয় একথা সবাই জানেন বিশেষত অভিবাবকগণ যারা ভুক্তভোগী। 

মানসিক রোগ চিকিৎসায় অন্যতম জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতির নাম ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপী (ECT) যা তথাকথিত ‘শকথেরাপি’ নামে অধিক পরিচিত । মহিলাদের প্রসবোত্তর জটিল মানসিক রোগ, আত্মহত্যা ও হত্যার প্রবণতা , তীব্র বিষন্নতা যেখানে ঔষধ থেকে দ্রত ফল পাওয়া যাচ্ছে না, রোগীর আহার বন্ধ হওয়া ও নিথর হয়ে যাওয়া, স্কিটজোফ্রিনিয়া, ম্যানিয়া প্রভৃতি রোগের কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় এ চিকিৎসা অত্যন্ত দ্রুত ও কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। কিন্তু, এ চিকিৎসা সম্পর্কে জনগণের বিভ্রান্তি প্রবাদতুল্যজনগণের মাঝে এ চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে রয়েছে ভয় ও আতংক। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর কার্যকারিতা, মানবদেহে সহনীয়তা ও নিরাপদ ব্যবহারের সফল প্রমাণ পাওয়া যায়। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নির্ভর করে এক থেকে দুই মিনিটের অবেদন (Anesthesia) প্রক্রিয়ার উপর । 
মানসিক রোগ সম্পর্কে মিডিয়ার আগ্রহ বর্তমান সময়ে যে কোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। বিগত বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে (১০ অক্টোবর) প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচার তার প্রমাণ যা উৎসাহব্যঞ্জক। কিন্ত প্রায়ই শেকল বাধা মানসিক রোগীর ছবি ও রোগীর অসংলগ্ন কথাবার্তা প্রচারে অতিউৎসাহ দেখা যায়। এ ধরনের রোগীর চিকিৎসার পর সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে ঘরে ফেরার দৃশ্য প্রচার করতে খুব একটা দেখা যায়না। টিভি নাটকেও এ বিষয়গুলি প্রায়ই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয় যা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে উৎসাহিত করে। একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন নির্মাতা ও পরিচালকের নাটকে আমরা দেখি কীভাবে মফস্বল শহর থেকে স্বামীকে খুঁজতে আসা একজন ভদ্রমহিলা একটা ফোন করতে এসে নাম বিভ্রাটে জোরপূর্বক একটি প্রাইভেট মানসিক ক্লিনিকে ভর্তি হয়। এর পর দেখি অন্যান্য মানসিক রোগীর অস্বাভাবিক আচরণের দৃশ্য এবং এসব রোগীর সংস্পর্শে আসার পর এ ভদ্রমহিলার মধ্যে অনুরূপ জটিল ধরনের মানসিক রোগের লক্ষণ প্রকাশ যেমন, হ্যালুশিনেশন (Hallucination) । আষাঢ়ে গল্পেরও একটা সীমা থাকে। মানসিক রোগ কোন ভাইরাস সংক্রমণের মত ছোঁয়াচে রোগ নয় যে রোগীর সংষ্পর্শে আসলে তারও এ ধরনের মানসিক সমস্যা হবে। কতটা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আর অজ্ঞতা থাকলে নাটকটির পরিচালকের মাথায় এ ধরনের ভাবনা আসে তা সহজেই বোঝা যায় । এ ধরনের টিভি নাটক দর্শকদের মাঝে মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা সম্পর্কে কী বার্তা দেবে তা সহজেই অনুমেয়।

বর্তমানে আধুনিক মানসিক রোগ চিকিৎসা গ্রহণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছেনি। আর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কাজ খুব একটা সহজ নয়। এজন্য প্রয়োজন মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে জনসচেতনা তৈরি করা । প্রতি বছর ১০ অক্টোবর ঘটা করে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন তার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস।আর মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞগণ মনে করেণ রোগী দেখেই তাদের দায়িত্ব শেষ। তাদের এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথাও মনে রাখতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবাদানকারী পেশাজীবি ও জনগণের মধ্যে আরও যোগাযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মুক্ত আলোচনা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
মানসিক রোগ চিকিৎসায় জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, স্বাস্থ্যশিক্ষা ও যোগাযোগ বাড়ানো অতি জরুরী। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগণের শতকর ১৬ ভাগ ও শিশুকিশোরদের শতকরা ১৮ ভাগ যেকোন ধরনের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর মানসিক স্বাস্থ্যকে বাদ দিয়ে জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই মানসিক রোগ চিকিৎসায় নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে সকলের সহযোগিতা কাম্য। 

কৃতজ্ঞতাঃ জিল্লুর রহমান রতন



No comments:

Post a Comment