

‘ভাই ঘরে আমার দেড় বছরের সন্তান রয়েছে। সে এতক্ষণে হয়তো খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছে। দয়া করে তার জন্য হলেও আমাকে বাঁচান। মরার আগে তার মুখটা দেখে মরতে চাই’- এমন আর্তনাদ শোনার পর আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে ছুটে গিয়েছিলাম উদ্ধারকাজে। আজও সেই কথা আমার কানে ভেসে উঠে। মনে হয় এখনও আমাকে ডাকছে কেউ। তাদেরকে বাঁচানোর জন্য রানা প্লাজা ভবন ধসে উদ্ধারকর্মী খোকন এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সেই দিনগুলোর কথা। রানা প্লাজা ভবন ধসের ১ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আহত শ্রমিক ও উদ্ধারকর্মীদের। ভবন ধসে আহতদের আহাজারি, আর্তনাদ বারবার কানে
ভেসে উঠে। মানবতার টানে ছুটে গিয়েছিলেন সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির উদ্ধার কাজে। এখন তাদেরই কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবন। দুঃখ- দুর্দশায় পার করছেন সময়। ব্যবসা- বাণিজ্য হারিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বীভৎস স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে। আলী আশরাফ খোকন, জাকির হোসেন, মো. বাদল মিয়া, মো. রফিক, হাসান মাহমুদ ফোরকান, আবদুর রহমান তোতা, আবদুল মজিদ, দীন ইসলাম, মোবারক হোসেন, মোবারক খান, শফিউল আলম শফিক, আফরোজা, দারোগ আলী, নূর হোসেন, আফতাব সহ আরো অনেকে ছুটে গিয়েছিলেন উদ্ধারকাজে অংশ নিতে। ২৪শে এপ্রিল ভবন ধসের পর থেকে ১৪ই মে উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার দিন পর্যন্ত রাত-দিন সেখানেই পড়েছিলেন তারা। জীবনকে তুচ্ছ করে চরম ঝুঁকি নেন মানবতার ডাকে সাড়া দেয়া এসব কর্মীরা। ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনেন গলিত, বিকৃত লাশ, অর্ধমৃত, হাত-পা হারানো আহতদের। কিন্তু উদ্ধারকাজে অংশ নেয়াই কাল হলো তাদের জন্য। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে অস্বাভাবিক, অনাকাঙিক্ষত, বীভৎস ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন তারা। ফিরেও এসেছিলেন সফলতার সঙ্গে। কিন্তু প্রশংসনীয় উদ্ধারকাজে সফল হলেও জানতেন না কি দুঃসহ যন্ত্রণা অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পর থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন কেউ কেউ। আলী আশরাফ খোকন থাকতেন রাজধানীর মতিঝিল মুগদা থানার পাশে একটি মেসে। নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য ঢাকা এসেছিলেন। শুরু করেন ফলের ব্যবসা। মতিঝিলের ফুটপাথে তার ফলের দোকান ছিল। ২৪শে এপ্রিল টেলিভিশনে রানা প্লাজা ধসের পর ঘটনার ভয়াবহতা দেখে ছুটে যান সেখানে। যোগ দেন উদ্ধারকাজে। দিন- রাত এক করে কাজ করেন। খাওয়া-ঘুম সব ভুলে ছিলেন তখন। ১৩ই মে পর্যন্ত সেখানে রাত-দিন অবস্থান করেন। অন্যদের সঙ্গে উদ্ধারকাজ চালিয়ে যান। উদ্ধারকাজ শেষে ফিরে আসেন নিজ বাসায়। তখনই শুরু হয় দুঃসহ দিনের। ব্যবসার পুঁজি হারিয়ে ফেলেন। মানসিক ভাবে হয়ে পড়েন বিপর্যস্ত। কোনভাবেই চোখের পাতা এক করতে পারেন না। শুধু একই দৃশ্য ভেসে উঠে। গলিত লাশের গন্ধ পান সবসময়। আহতদের আর্তনাদে কান ভারি হয়ে যায় তার। খোকন জানান, এসময়ের এই যন্ত্রণার ফলে কয়েকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। জীবনের প্রতি তার অনীহা চলে এসেছিলো। তিনি আরো জানান, এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণে তাকে ১৯শে জুন ভর্তি করা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে একটু সুস্থ হয়ে সেখান থেকে ফিরে আসলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। রানা প্লাজা ধ্বংসস্তূপে উদ্ধারকর্মী হিসেবে ছিলেন মো. বাদল মিয়া। তিনি সাভারের একটি সোয়েটার কোম্পানিতে কাজ করতেন। ঘটনার দিন সবকিছু ফেলে রেখে ছুটে এসেছিলেন। উদ্ধারকাজে নিয়োজিত হয়ে তিনি এখন অসহায়। ৪ বছরের এক সন্তানকে নিয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। চোখের সমস্যার কারণে কাজ করতে পারেন না। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তার ভালই দিন কাটছিলো। দুজনেই কাজ করতেন। কিন্তু এখন বাদল কোন কাজ করতে পারেন না। স্ত্রী যা বেতন পান তা দিয়ে চলা খুবই কষ্টকর। বাদল জানান, মনকে বেঁধে রাখতে পারছিলাম না তাই ছুটে গিয়েছিলাম উদ্ধারকাজে। সেখান থেকে আসার পর আমার জীবন পুরোটাই তছনছ হয়ে গেছে। সেই স্মৃতির যন্ত্রণায় দিন কাটছে। ভালো কিছু ভাবতেই পারি না। প্রতিটি মুহূর্ত তাড়িয়ে বেড়ায় সেই দিনগুলোর স্মৃতি। জাকির হোসেন সাভারে ইপিজেডের এলাইন্স ইস্টিজেস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। ভবন ধসের পর শুনতে পান তার চাচাতো বোন মাসুমা সেখানে আটকা পড়েছে। তা শুনে ছুটে যান সেখানে। প্রাণপণে খুঁজতে শুরু করেন নিজের বোনকে। তখন যারা উদ্ধারকাজ করছিলেন তাদের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। স্ত্রী-সন্তান, বাবা- মা সবার কথা ভুলে তখন তিনি উদ্ধারকাজ করেন। তবে খুঁজে পাননি তার বোন মাসুমাকে। তবে উদ্ধার করেছেন অনেক ভাইয়ের বোনকে। উদ্ধারকাজ থেকে ফিরে এসে তিনি যোগ দেন তার কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু সেখানে কাজ করতে পারেননি। তার চাকরি চলে যায়। সহকর্মীদের সঙ্গে তার অস্বাভাবিক আচরণ দেখে সবাই তাকে চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এরপর থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। রাতে ঘুমাতে পারেন না। তিনি বলেন, যখন উদ্ধারকাজ করতে গিয়েছি তখন মানুষের প্রশংসার শেষ ছিলো না। অনেকে আমাদের জন্য অনেক কিছু করবেন বলেছিলেন। কিন্তু ১ বছর হয়ে গেলো এই ঘটনার পর চাকরি হারিয়ে অসহায়ের মতো ঘুরছি। কিন্তু কারও কাছে গিয়ে একটা চাকরি পাচ্ছি না। রানা প্লাজা ধসের ঘটনার দিন সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন আবদুর রহমান তোতা, সেখানে উদ্ধার করেন অনেক জীবিত ও মৃত মানুষকে। ইলেক্ট্রিকের যা কাজ ছিলো সেখানে তার যাবতীয় সাহায্য করেন। তিনি বলেন, সেখানে গিয়ে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলাম দেখতে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ভেসে আসা মানুষের আর্তনাদে আমি সেখানে উদ্ধারকাজ শুরু করি। একটি জায়গা থেকে ৪ জন মানুষের আর্তনাদ শুনে সেখানে ছুটে যাই। অনেক কষ্ট করি তাদের উদ্ধারের জন্য। কিন্তু সেখান থেকে একজনকে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। এ কথাটি আজও আমাকে পীড়া দেয়। শেষ দিন পর্যন্ত চাপা পড়া অনেককে হাত-পা কেটে বের করেছি। উদ্ধারকাজ শেষ হওয়ার পরই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। কোন কিছু ভালো লাগতো না। মানুষের কান্না কানে ভাসতো। খেতে বসলে পচা লাশের গন্ধ মনে হতো। এখনো আমি স্বাভাবিক ভাবে জীবনযাপন করতে পারছি না। কোন কাজ করতে পারছি না। শুধু একই স্মৃতি চোখে ভেসে উঠে। আমাকে ডাকছে তাদের উদ্ধার করার জন্য।
No comments:
Post a Comment