অবশেষে উদঘাটিত হলো সাভারজুড়ে আলোচিত ‘গেছো-মানবী’র রহস্য। এক নারীকে নিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয় সাভারজুড়ে। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে পুরো রাত চেষ্টা চালিয়ে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন সেনাবাহিনী, পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যরা। তবে গাছের উপরে বসে থাকা ওই নারীর তত্পরতায় বেশি
দূর এগোয়নি উদ্ধার অভিযান। অবশেষে অভিযান স্থগিত করে গেছো-মানবীকে উদ্ধার না করেই ফিরে যান তারা।
সাভার এলাকাবাসী জানান, রাত হলেই এলাকার কোনো না কোনো গাছ থেকে নারীকণ্ঠ শুনতে পান তারা। গাছের মগডালে বাস করা ওই নারীর ভয় দেখিয়েই সন্তানদের ঘুম পাড়ান ওই এলাকার মায়েরা। অনেকে রোগ-ব্যাধি থেকে সেরে ওঠার জন্য তার কাছে মিনতিও করছেন। অদ্ভুত এই নারীকে ঘিরেই গত বৃহস্পতিবার নির্ঘুম রাত কাটাতে হলো সেনা, পুলিশ ও দমকল বাহিনীর সদস্যদের। এলাহিকাণ্ড বাঁধিয়েও শেষ পর্যন্ত তাকে নামানো যায়নি গাছ থেকে। শত শত মানুষের উপস্থিতিতে গেছো-মানবী উদ্ধারের ব্যর্থ প্রচেষ্টায় ইতোমধ্যে ওই এলাকায় তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। গত বৃহস্পতিবার রাত আটটার দিকে সাভারের সামরিক খামারের একটি গাছের নিচ দিয়ে এক রাস্তা অতিক্রম করার সময় গাছ উপর থেকে নারীকণ্ঠ শুনেই চমকে যান কেরামত আলী। তিনি বলেন, গল্পে অনেক ভূত-প্রেতের কথা শুনেছি। মনে হচ্ছিলো বাস্তবে আমিও ভূতের পাল্লায় পড়েছি।
কেরামত আলী বলেন, মনে মনে আমি আল্লাহকে ডাকতে থাকি, আর জোর কদমে পা চালাই। যতই পায়ের জোড় বাড়ে ততই যেন কাছে আসে নারীর কণ্ঠস্বর। ভাবছি এই বুঝি আমাকে ধরে ফেলে। দৌড়ে কোনো মতে রেডিও কলোনির কাছাকাছি পৌঁছে বিষয়টি নিকটজনদের জানাই। এরপর এ-কান ও-কান হয়ে প্রশাসন পর্যন্ত গড়ায়।
কেরামত আলী আরো বলেন, পরে আরেক পথচারীর একই অভিজ্ঞতার খবর শুনে প্রথমে পুলিশ, পরে দমকল বাহিনিকে খবর দেন। পরে সেনা সদস্যরাও যান ঘটনাস্থলে। টর্চের আলোতে দেখি এক নারী বসে আছে গাছের মগডালে। আর তাকে নিচে নামিয়ে আনতে কতই না তত্পরতা প্রশাসনের।
কেবল কেরামত আলী একাই নন, গেছো-মানবীর ছায়া মাড়িয়েছেন অনেকেই। তবে কেউ বিভ্রম কেউ বা ভূত বলেই বিষয়টি নিজেদের মধ্যে রেখেছেন এতদিন। তবে বিভিন্ন বাহিনীর যৌথ তত্পরতায় ওই নারীকে গাছ থেকে নামানোর ব্যর্থ চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ভূত পরিচয় থেকে রক্ষা করে ওই নারীকে। বেরিয়ে আসে তার মানবী পরিচয়।
সাভার মডেল থানার ওসি মোস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, গেছো-মানবীর খবর পেয়ে রাত রাত ৯টায় ঘটনাস্থলে পুলিশ নিয়ে যাই আমরা। তাকে গাছ থেকে নামানোর চেষ্টা করলে তিনি ঘাড় মটকে দেবেন হুমকি দেয়। তাকে ধরতে গেলে সে গাছ থেকে লাফিয়ে মরবে এই রকম ভয় দেখাতে থাকে। হাজার হোক একজন নারী। এই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমরা তাকে উদ্ধারের জন্যে খবর দেই ফায়ার ব্রিগেডে। সাইরেন বাজিয়ে তারা আসতে না আসতেই সেখানে চলে আসেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা।
স্থানটি সেননিবাস এলাকায় হওয়ায় বিব্রত হন সেনাসদস্যরা। কীভাবে ওই নারী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে সেনানিবাস এলাকায় প্রবেশ করে একটি গাছে রাতযাপন করে, সে ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেন তারা। এতে দায়িত্ব পালনে নিরাপত্তাকর্মীদের কারো গাফিলতি থাকলে তার ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সেনা কর্মকর্তা।
সাভার ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন অফিসার শাহাদাত্ হোসেন বলেন, ওই নারীকে গাছ থেকে নেমে আসতে অনুরোধ করি। কিন্তু সে গর্জন করে আমাদের বকা দিতে থাকে। নিজেকে জিন দাবি করে তিনি বলতে থাকেন, কেউ জোর করে তাকে নামানোর চেষ্টা করলে তার পরিবারের অমঙ্গল হবে।
লাফিয়ে পড়ারও হুমকি দিতে থাকে সে। অসাবধানতায় গাছ থেকে পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রাত পার করে দিই, বলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা। এরপর খবর পেয়ে ওই নারীর ছেলে মঞ্জিল হোসেন ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে আমাদের জানান, সময় হলে তিনি নিজের ইচ্ছায় গাছ থেকে নেমে আসবেন।
ছেলে মঞ্জিল হোসেন বলেন, আমার মায়ের নাম আমেনা (৪৫)। গাছ থেকে ভূত নামানোর খবর শুনেই আমি ছুটে যাই সামরিক খামারে। মাকে অনেকক্ষণ ডাকাকাকি করে গাছ থেকে নেমে আসতে বলি। কিন্তু কোনো কথাই শোনেন না মা।
মঞ্জিল জানান, আমরা জানতাম মা দীর্ঘদিন ধরেই রাতে গাছে বসবাস করেন। তবে চক্ষুলজ্জায় বিষয়টি আমরা কাউকে প্রকাশ করিনি এতদিন। প্রায় দিনই গাছে রাতযাপন করছেন আমার মা। একবেলায় গাছে উঠলে পরের বেলায় নির্দিষ্ট সময়ে নেমে আসেন তিনি।
তিনি বলেন, ধরেন যদি বিকেল ৪টায় গাছে ওঠেন তাহলে গাছ থেকে নামবেন ঠিক ভোর ৪টায়। এটাই মায়ের নিয়ম। আমরা প্রথম প্রথম খোঁজ নিতাম। গাছে গাছে টর্চ লাগিয়ে মাকে খুঁজতাম। এখন বিষয়টি গা সওয়া হয়ে গেছে, বলেন মঞ্জিল হোসেন।
তিনি আরো জানান, অনেক বলেছে এটা নাকি মানসিক ব্যাধি। আধুনিক চিকিত্সা করানোর সামর্থ আমাদের নেই। কবিরাজের শরণাপন্ন হয়েছি, তাবিজ-কবজ দিয়েছি। কিন্তু তিনি এখনো জিনের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
আমেনার মেয়ে রুবিনা বেগম বলেন, বিকেল ৩টা নাগাদ ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েন মা। এক পর্যায়ে আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়েই উধাও হয়ে যান মা। পরে রাতে আবিষ্কার করি গাছের মগডালে রয়েছেন তিনি।
রাতে টহলে থাকা এক পুলিশ সদস্য জানান, সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে আমরা নিজেরা এক পর্যায়ে পদক্ষেপ নেই ওই নারীকে গাছ থেকে নামিয়ে আনতে। একজন গাছে ওঠামাত্রই প্রচণ্ড শক্তিতে সে গাছে ঝাঁকুনি দিতে থাকে। শেষে ভোরে উপস্থিত অনেকের চোখকে কপালে তুলে শান্ত আর স্বাভাবিকভাবে গাছ থেমে নেমে আসে গেছো-মানবী। এরপর ছেলে আর মেয়ের হাত ধরেই বাড়ির পথে হাঁটা দেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের আধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম জানান, এ ধরনের রোগি সাধারণত সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। তারা মানষিক বিভ্রাট ও হ্যালো সিনেশন ভোগে। তারা মনে করে কারো নির্দেশে পালন করতে এই কাজগুলো করে। অনেকে ভাবে আমিতো বানর বা জিন তাহলে আমি বাসাতে কেন থাকবো। আমার তো থাকার কথা গাছে। সেই চিন্তায় সে গাছে উঠে থাকে। তার বিভ্রাট কেটে গেলে নেমে আসে। এ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীদের সাইকিয়াটিক্সকে দেখানো হলে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিত্সা নিলে ঠিক হয়ে যায়। তবে আনেক সময় লাগে পূর্ণ সুস্থ হতে।
এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাইকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুর রহিম জানান, এটা অসুখ, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে ওই নারী সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। গ্রামে অশিক্ষা আর কুসংস্কারের প্রভাবে এসব রোগীদের অনেকেই জিনে ধরেছে বলে মনে করেন। সিজোফ্রেনিক রোগী যথাযথ চিকিত্সায় সুস্থ হয়ে ওঠেন বলেও জানান চিকিত্সক আব্দুর রহিম।
জানা গেছে, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সস্টিটিউটে ভর্তি হওয়া রোগীদের ৩৫ শতাংশই সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। চিন্তা, বোধশক্তি, ভাষা ও আত্মউপলব্ধি নষ্ট করে দেয়ার মতো ভয়াবহ রোগটি এখন দেশের সবচেয়ে বড় মানসিক রোগে পরিণত হয়েছে। গতবছর মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছিল ২১৪০ জন রোগী। তাদের ৩৫ জনেরও বেশি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও এই হার একই ছিল- ২০০৯ সালে ৩৫.৫৩ শতাংশ, ২০১০ সালে ৩৭.৫৮ শতাংশ, ২০১১ সালে ৪৩.৪৭ শতাংশ এবং ২০১২ সালে ছিল ৩৮.১ শতাংশ। এ বছর প্রকাশিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। অবশ্য এই মুহূর্তে দেশে কয়জন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, তা জানার জন্য কোনও জরিপ চালানো হয়নি।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ড. মোহিত কামাল জানান, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের সঠিক ও নিয়মিত চিকিত্সা হলে তারা আবারও কর্মক্ষম ও সামাজিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। তবে বেশিরভাগ রোগীর চিকিত্সা মাঝপথে থামিয়ে দেয়া হয় বলে দাবি করেন তিনি। তার মতে, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের জীবনে নতুন করে সুযোগ দেয়াটা ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ ও পরিবারের লোকজনকে সম্মিলিত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, সাধারণত সিজোফ্রেনিয়ায় রোগীদের মধ্যে ২৫ শতাংশই চিকিত্সা পেলে পুরোপুরি সেরে যায়। ২৫-৩৫ শতাংশ নিয়মিত ওষুধ সেবনে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। ১০-১৫ শতাংশ সচরাচর কখনই সেরে ওঠে না এবং ১০-১৫ শতাংশ রোগী আত্মহত্যা করে বা করতে চায়।
তার মতে, দেশে এই মুহূর্তে প্রায় পাঁচ লাখ সিজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বজুড়ে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ৬০ লাখ।
No comments:
Post a Comment