Monday 13 May 2013

রাগ


রাহুল সাহেব বিবাহিত। চাকরি করেন, কিন্তু কোথাও তিনি বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেন না। সমাজের সবার সাথেই মোটামুটি মিলেমিশে চলেন। অথচ বাড়িতে তিনি সম্পূর্ণ অন্য রকম মানুষ, সামান্য বা তুচ্ছ ঘটনাকেও তিনি বড় করে দেখেন। পান থেকে চুন খসলেই তার মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়। মাথা হিট হয়ে রাগের ঘোলাটে ধোঁয়া বেরুতে শুরু করে। রাহুল সাহেব, রাগে উত্তেজনায় আগুনের রূপ ধারণ করেন। সাপের মতো ফোঁস করে ওঠেন। শুধু তাই নয়, পরিবারের সদস্যদের তিনি রাগের বশে প্রায়ই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনও করতে ছাড়েন না। কোনোভাবেই তার রাগকে কন্ট্রোল করা যায় না।
রাগের বশবর্তী হয়ে অশ্লীল বাক্য বলতেও এতটুকু দ্বিধাবোধ করেন না। নিজের অযৌক্তিক রাগকে তিনি যৌক্তিক মনে করে তা লালন করতে থাকেন এবং তার সেই রাগের ওপর অনড় থাকেন। ফলে পরিবারের সবাই তাকে অন্য চোখে দেখে, এড়িয়ে যায়।
বাবা-মার আদরের মেয়ে বিউটি। চঞ্চল-উচ্ছল-সরল প্রকৃতির বিউটির মুখে মিষ্টি মধুর হাসি সব সময় লেগেই থাকে। তার হাসি সবার মনে আনন্দ জাগায়, উৎফুল্ল করে। সবাই তাকে আদর করে, স্নেহ করে, ভালোবাসে। সে যে তার মায়ের চোখের মণি, চাঁদের টুকরো। মা তার কোনো আব্দারই পারতপক্ষে অপূরণ রাখেন না।
মেয়েটি বড়দের যেমন শ্রদ্ধা করে, মান্য করে তেমনি ছোটদেরও স্নেহ-মমতায় ভরিয়ে দেয়। মন ভালো থাকলে যে কাজের কথাই বলা হোক না কেন তা সে খুশি মনেই করে দেয়। কিন্তু মাঝে মাঝে বিউটির কী যেন হয়ে যায়। কোনো কারণে যখন সে রেগে যায় তখন আর তার সেন্স থাকে না। রাগে, অভিমানে ওর মুখ লাল হয়ে যায়। তখন আর তাকে পায় কে? কোনোভাবেই তাকে সামলানো যায় না, রাগ তার থামানো যায় না। রাগের মাথায় সে অস্থির হয়ে যায়, দিকভ্রান্ত হয়।
কিন্তু বিউটির এ রাগ যেমন বিদ্যুতের গতিতে হঠাৎ করে জ্বলে ওঠে, তেমনি তা আবার কয়েক মুহূর্ত পরেই মোমের মতো গলে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আবার মুখে তার সেই মিষ্টি হাসি গোলাপ ফুলের মতো ফুটে ওঠে। সুবাস ছড়াতে থাকে চারদিকে। বিউটি ভাবে কেন আমার এমন হয়? কেন আমি রাগের মাথায় সব ভুলে যাই। আমি তো এমন রাগ চাই না। আমি চাই সৌরভ, যে সৌরভ মনেপ্রাণে শান্তি এনে দেবে, এনে দেবে অনাবিল আনন্দ।
ত্রপা তার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে অথচ তার বন্ধুর কোনো খবর নেই। অপেক্ষা করতে করতে এক ঘণ্টা কেটে গেল। বসে বসে দাঁত দিয়ে নিজের নখ কামড়াচ্ছে নিষ্ঠুরভাবে। বন্ধু আসতেই রাগে ফেটে পড়ল। ত্রপা তার বন্ধুর দিকে রাগের বশে এমনভাবে দেখল যেন তাকে চোখ দিয়েই গিলে ফেলবে।
পাঠক বুঝতে পারছেন আমাদের এবারের কৌতূহলী বিষয়টি হচ্ছে রাগসম্পর্কিত। রাগ কে না করে। সবাই রাগ করে, যুবক থেকে শুরু করে বৃদ্ধরাও রাগ করে, শিশুরাও রাগ করে। একজন কোটিপতি যেমন রাগ করে তেমনি একজন দরিদ্র ব্যক্তিও রাগ করে। তবে একেকজনের রাগের মূল্য একেক রকম হয়ে থাকে। বসের রাগের মূল্য যত বেশি কর্মচারীর রাগের মূল্য ততটা বেশি নয়। তবে রাগ সবার শরীর ও মনের জন্যই সমানভাবে ক্ষতিকর।
পৃথিবীতে প্রত্যেকটি মানুষের স্বভাবে জন্মগতভাবে কমবেশি রাগপ্রবণতা থাকে। এ রাগ অস্বাভাবিক কোনো মানসিক বৈকল্য কিংবা স্নায়ুতন্ত্রের কোনো রোগ নয়, বরং একটি সুস্থ মানবিক আবেগ বা ইমোশন। সুস্থ মনের অত্যন্ত স্বাভাবিক উপাদান হলো এই রাগ। বাংলা একাডেমির ইংরেজি-বাংলা অভিধানে রাগ করার ইংরেজি ‘অ্যাংগরি’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে ‘কারো সঙ্গে, কারো কোনো কথায় বা কাজে, কোনো ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হওয়া (রাগান্বিত হওয়া)’। গ্রেট ব্রিটেনের খড়হম সধহ ঈড়হঃবসঢ়ড়ৎধৎু ঊহমষরংয ফরপঃরড়হধৎু-তে রাগের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে, এ স্ট্রোঙ অ্যান্ড সামটাইমস ভায়োলেন্ট ফিলিং অব ডিসপ্লেজার ইজুয়ালি, লিডিং টু এ ডেস্যায়ার টু হার্ট অর স্টপ দ্যা পারসন অর থিঙ কেসিং ইট, এক্সট্রিম অ্যানোয়ানস’ অর্থাৎ একটি জোরালো এবং কখনো কখনো হিংস্র অনুভূতি ও মনোভাব যা সাধারণত কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি আক্রমণাত্মক এবং প্রচণ্ড বিরক্তি উদ্রেককর। রাগের ইংরেজি অ্যাংগরি শব্দের বহু প্রতিশব্দ লক্ষ করা যায়। যেমন-
  • ইরেট
  • ইনরেগড
  • ইগজাস পারেটেড
  • ইফারিয়াগটেড
  • হিটেড
  • ব্রিস্টলিং
  • ফায়ারি
  • অ্যাক্সাইটেড
  • ফারিয়াস
  • কলারিক
  • ডিসগ্রানটলড
  • ইর‌্যাসবল
  • আউটরেইজ
  • কুইক-ট্যাম্পারেড
  • ইল-ট্যাম্পারেড
  • শর্ট-ট্যাম্পারেড
  • ব্যাড-ট্যাম্পারেড
  • টেসটি
  • টাচি প্রভৃতি
রাগের পরিচয়
বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ড. চ্যার্লস স্পিলবার্গারের সূত্র মতে, রাগ হলো এমন প্রকৃতির এক আবেগ যা কিনা বিরক্তিবোধ থেকে তীব্র আক্রোশ ও প্রচণ্ড উত্তেজনা পর্যন্ত বিস্তৃত অনুভূতি।
অর্থাৎ কোনো প্রণোদনার কারণে সামান্য বিরক্তি থেকে শুরু করে প্রবল উত্তেজনা, ক্রোধ, উন্মত্ততা পর্যন্ত এ আবেগের বিস্তৃতি হতে পারে। মানুষের ষড়রিপুর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে এই আবেগটিকে রাখা হলেও মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় এবং শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপে এটি মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার অন্যতম উপাদান। কিন্তু যদি এ আবেগটিকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, যদি এ আবেগটি অতি উচ্ছ্বসিত আকারে প্রকাশ পায় তখন দেখা দেয় নানা সমস্যা। সমস্যা হতে পারে মনোদৈহিক, সমস্যা হতে পারে পারিপার্শ্বিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে, হতে পারে সামাজিক সমস্যা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনি জটিলতায় পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
রাগের প্রতিক্রিয়া
যে কোনো মানুষ যে কোনো সময় যে কোনোভাবে হঠাৎ করে রেগে আগুন হয়ে যেতে পারেন। মানুষের অন্যান্য আবেগের মতো রাগের ফলে বেশ কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন-
  • হার্টের গতি বেড়ে যায় বা প্যালপিটিশন দেখা দেয়।
  • রক্তচাপ বা ব্লাডপ্রেসার বেড়ে যায়।
  • মাথায় রক্তচলাচল বেড়ে যায়।
  • মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায় চাপের সৃষ্টি হয়।
  • এমনকি কোনো কোনো সময় ব্রেন স্ট্রোকের মতো ঘটনাও ঘটে যেতে পারে।
  • শরীরে মৃদু কম্পন সৃষ্টি হয়।
  • শরীরের পেশি টানটান হয়ে যায়।
  • শরীর গরম হয়ে আসে।
  • চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়।
  • ভ্রূ কুঁচকে যায় সেই সাথে শক্তিদায়ক হরমোন অ্যাড্রিনালিন ও নরঅ্যাড্রিনালিন হরমোনের মাত্রা বা নিঃসরণ বেড়ে যায়।
  • শরীরের প্রয়োজনীয় লবণ ও জলীয় অংশ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়।
  • এনার্জি ক্ষয় হয়।
রাগের প্রকাশ
  • রাগের সময় মানুষ হিংস্র ও আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে
  • কণ্ঠস্বর উচ্চমাত্রার হয়।
  • সাধারণ জ্ঞান লোপ পায়।
  • লজ্জা-শরম উঠে যায়।
একজন নম্র-ভদ্র স্বভাবের কোনো ব্যক্তিও যদি হঠাৎ কোনো কারণে প্রচণ্ড রেগে যায় তখন তার এই রাগ বা ক্রোধান্ধতা তার নম্র-ভদ্রতার সীমানা অতিক্রম করে মারাত্মক পর্যায় পর্যন্ত চলে যেতে পারে। রাগলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না, কনফিউজড হয়ে যায়। এ সময় মানুষ যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারে। রাগজনিত সমস্যা সম্পর্কে আমাদের সবারই কমবেশি ধারণা আছে। তবে এই রাগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বা ভয়াবহ রূপ ধারণ করলে যে কোনো অনাকাঙিক্ষত ফলাফল বয়ে নিয়ে আসতে পারে। রাগ ভালো মানুষকেও মুহূর্তের জন্য মন্দ মানুষে পরিণত করে দিতে পারে। এমন অনেক মিষ্টি স্বভাবের ব্যক্তি আছে যাদের মুখ থেকে সুন্দর সুন্দর বাক্য নিঃসরণ হয়; কথার মাধুর্যে মন-প্রাণ ভরে যায়, পুলকিত হয় হৃদয়। কিন্তু এই সুন্দর-সুন্দর কথা বলা মানুষটির মুখ থেকেও রাগের সময় অসুন্দর জঘন্য ও অশ্লীল কথা বা গালাগাল পর্যন্ত উচ্চারিত হয়ে যেতে পারে। যা শুনে হয়তো আপনাকে থমকে দাঁড়াতে হতে পারে অথবা আপনি হয়ে যেতে পারেন কিছুক্ষণের জন্য আশ্চর্যের নির্বাক পুতুল। একেকজনের রাগ একেক রকমের, একেক মাত্রার। বিচিত্র তার রূপ ও রঙ যেমন-
  • অনেকে রাগান্বিত হলে প্রতিপক্ষের দিকে চোখ বড়বড় করে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে- যেন চোখ দিয়ে তাকে গিলে ফেলবেন।
  • কেউ কেউ আছেন যারা রাগের যাতনা সহ্য করতে না পেরে কেঁদে দেন।
  • এমন লোকও আছে যারা রাগলে তা অন্যের ওপর প্রয়োগ করতে না পারলে নিজের ওপরই প্রয়োগ করেন।
  • কেউ কেউ রাগের সময় নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরেন বা ঠোঁট কামড়াতে থাকেন।
  • কেউ কেউ দাঁতে দাঁত পিষতে থাকেন।
  • কেউ কেউ আবার নিজের মাথার চুল টেনে ধরেন।
  • এমন ব্যক্তিও আছেন যিনি প্রচণ্ড রাগের সময় তা সামলাতে না পেরে কোনো কিছুতে মাথা ঠোকেন।
  • নিজের হাত নিজে কামড়াতে থাকেন কেউ কেউ।
  • কারো কারো রাগ আবার বিধ্বংসী টাইপের। এসব টাইপের মানুষরা রাগে অন্ধ হয়ে ঘরের মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করে দেয়। হাতের কাছে যা পায় তাই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়-নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। কেউ কেউ চা বা কফির পিরিচ ভাঙতে পছন্দ করে, কেউবা আসবাবপত্রও ভাঙতে লাইক করে। এসব টাইপের মানুষরা আবার কাচজাতীয় জিনিসপত্র ভাঙতে বেশি মজা পায়। যেমন-বাড়ির পানি বা দুধ পান করার গ্লাস থেকে শুরু করে দামি দামি গাড়ির কাচের গ্লাস ভাঙতেও অনেকের জুড়ি নেই। যেমন রাস্তাঘাটে যখন মিছিল-মিটিং হতে থাকে সেসব মিছিল-মিটিংকারীদের রাগ যেন দামি দামি কাচের মধ্যেই বেশি থাকে। এটাও এক ধরনের রাগের জ্বালা।
    অনেকের রাগ আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে থাকে। তারা রাগের বশবর্তী হয়ে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে এবং এমনকি কখনো কখনো এদের আক্রমণ এত ভয়াবহ ও মারাত্মক হয় যে, তা কল্পনা করলেও ভয়ে অনেকের দেহ-মন কেঁপে উঠবে, প্রাণাত্মা শুকিয়ে যাবে। এ ধরনের হিংস্র রাগান্বিত ব্যক্তি যদি রাগের বশে কাউকে আঘাত করে তাহলে অনেক সময় নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করে আর যদি কাউকে মেরে ফেলে তাহলে তো কোনো কথাই নেই, একেবারে জালিমের মতো করে হত্যা করে ফেলে। এ ধরনের মানুষরা তাদের রাগের বিষ দিয়ে অনেক সুন্দর জীবন নষ্ট করে দেয়, বরবাদ করে দেয়। কেউবা প্রচণ্ড রাগের তাড়নায় অ্যান্টিসোশ্যাল অ্যাক্টিভিটিজ বা সমাজবিরোধী কার্যকলাপ যেমন-
  • মারামারি করা
  • ঝগড়া-ফ্যাসাদ
  • ধর্ষণ-অনাচার
  • নারী নির্যাতন
  • শিশু নির্যাতন কিংবা
  • এসিড নিক্ষেপের মতো জঘন্য, ঘৃণিত, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে।
সবাই কিন্তু আবার সমানভাবে রাগে না। কোনো কারণে কেউ হয়তো চট করে রেগে ওঠে যাদের আমরা বলি মাথা গরম, আবার কেউ বা তার চেয়ে বেশি রাগের কারণেও খুব বেশি রাগ করে না, কেউ হয়তো এতটাই রাগ করে যে তার রাগের কোনো বহিঃপ্রকাশ হলো না বটে, তবে পারিপার্শ্বিকতা থেকে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নেয়। এই যে একেকজনের রাগের প্রকাশ একেক রকম তার মূলে রয়েছে-
  • জেনেটিক প্রভাব
  • পারিবারিক প্রভাব ও
  • সামাজিক প্রভাব
জটিলতাপূর্ণ পরিবার ও বাবা-মায়ের অশান্তিময় দাম্পত্য সম্পর্ক   সন্তানকে অন্যান্য আচরণ বৈকল্যের পাশাপাশি রাগের প্রকাশভঙ্গিতেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। যেসব কারণে রাগের প্রকাশ ভিন্নতর হতে পারে তা হলো-
  • বর্ণ-বৈষম্য
  • রাজনৈতিক অস্থিরতা
  • যুদ্ধোত্তর সংঘাতময় রাষ্ট্র
  • অর্থনৈতিক দুরবস্থা
  • পেশাগত ঝামেলা
  • শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তা
  • বেকারত্ব
  • শোষণ-দমন-নিপীড়ন
  • অশ্লীলতা
  • অবজ্ঞা-অবহেলা
  • প্রতারণা/ঠকানো
  • অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া
  • ভালোবাসায় বিচ্ছেদ
  • ছলনা
  • অসুখী দাম্পত্য জীবন
  • ডিভোর্স
  • কাজের যথাসময়ে পারিশ্রমিক না পাওয়া
  • ভুল বোঝাবুঝি
  • হিংসা-বিদ্বেষ-শত্রুতা
  • অনিদ্রা
  • ক্ষুধা
  • দীর্ঘস্থায়ী রোগবালাই
  • কাজের দীর্ঘসূত্রীতা-একঘেয়েমি
  • অপবাদ-কলঙ্ক-দোষারোপ
  • অবনিবনা
  • নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য অধিক হারে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি
রাগ ও ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনালিটি
যার মেজাজ একটুতেই চটে যায়, সহজেই বিগড়ে যায়, সহজেই রেগে ওঠে, এরকম রগচটা-উগ্রতা ও রুক্ষ মেজাজের মানুষকে বলা হয় বদমেজাজি বা ব্যাড-ট্যাম্পারেড। বদমেজাজি ব্যক্তি ইম্পালসিভ হয়ে ঘটনা ঘটিয়ে দেয়। এরা নিজেদের আবেগকে খুব একটা ধরে রাখতে পারে না। ফলে অনেক রকমের সমস্যা দেখা দেয় এদের জীবনে।
প্রতিটি মানুষেরই কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য থাকে যা তার নিজের এবং বাস্তবজগৎ সম্বন্ধে ধ্যান-ধ্যারণা, আচার-অনুষ্ঠানকে দৃঢ়ভাবে নির্ধারণ করে। এই বৈশিষ্ট্যকেই বলা হয় ব্যক্তিত্ব বা পার্সোনালিটি এবং ব্যক্তির বিশেষত্ব দিয়েই একের সঙ্গে অন্যের ভিন্নতার বিচার করা যায়। এই ব্যক্তিত্ব তার শরীর-মনের সামগ্রিক গঠন এবং কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। ব্যক্তিত্বের এই গঠন একদিক থেকে তার বংশগত সুপ্ত সম্ভাবনা আর অন্যদিকে প্রাকৃতিক এবং সামাজিক পরিবেশের নানা অবস্থায় ঘাত-প্রতিঘাতের দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যখন এমন কিছু বিশেষত্ব থাকে যা তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতাকে খর্ব করে এবং তা ওই ব্যক্তি কিংবা সমাজের অন্যদের পক্ষে সমস্যাদায়ক বা ক্ষতিকারক হয়, তখনই ওই ধরনের ব্যক্তিত্বকে বলা হয় ব্যক্তিত্বের বিকার বা ব্যক্তিত্বের ত্রুটি। কিছু কিছু ব্যক্তিত্বে বা পার্সোনালিটি ব্যক্তি এমনিতেই একটু রাগপ্রবণ হয়ে থাকেন যেমন-
সিজয়েড ব্যক্তিত্ব (সিজয়েড পার্সোনালিটি)
এসব ব্যক্তিত্বের লোকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা আত্মকেন্দ্রিক, লোকজনের সঙ্গে এদের তেমন একটা মেলামেশা বা বনিবনা নেই। আন্তরিকতার অভাবের জন্য এদের সঙ্গে অন্যদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে না। রসবোধের স্বল্পতা এদের মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এই ধরনের ব্যক্তির অনেক রাগ থাকে। এরা সহজেই রেগে যেতে পারে।
সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব (অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি)
এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা অল্প বয়স থেকেই অপরাধপ্রবণ, দায়িত্বজ্ঞানহীন, বেপরোয়া, কলহপ্রবণ এবং বদরাগী স্বভাবের। এরা স্নেহ-ভালোবাসা বর্জিত নির্মম-নিষ্ঠুর অপরাধবোধহীন এবং নেশাদ্রব্যের প্রতি আসক্তি, বিচারবিহীন অশ্লীলতার প্রতি প্রবণতা এবং আনুগত্যের অভাবের ফলে এদের বিবাহিত জীবন কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এরা সব সময়ই রাগের যাতনায় ভুগতে থাকে। এদের কথাবার্তা, আচার-ব্যবহারে ক্রুদ্ধতা বা মেজাজের প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এরা নিতান্তই বদরাগী-ক্রোধপ্রবণ ব্যক্তিত্ব।
অ্যাংগার ম্যানেজমেন্ট স্পেশিয়ালিস্ট বা রাগ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ-মনোবিজ্ঞানী ড. ডেফেন বেকারের মতানুসারে, কিছু কিছু লোক সত্যিকার অর্থেই রাগী বা ক্ষেপাটে প্রকৃতির। এরা সহজেই যে কোনো তুচ্ছ কারণেও প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের মতে, যারা সহজেই রেগে ওঠে এ ধরনের লোক প্রায়শই হতাশায় ভুগে থাকে এবং এদের ধৈর্যের মাত্রাও থাকে কম। হতাশা-বিড়ম্বনা ও বিরক্তি সহজেই এদের বিচলিত করে তোলে।
  • কোনো কিছুই এরা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না
  • এরা যে কোনো ধরনের অসঙ্গতিতেই দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়ে এবং
  • ছোটখাটো ভুলেই এরা নিজেদের দিশা হারিয়ে ফেলে
  • কিছু কিছু শিশু আবার জন্মকাল থেকেই খিটখিটে স্বভাবের হয়ে থাকে এবং
  • এরা আবেগপ্রবণ ও রাগপ্রবণ হয়
রাগ ও মানসিক সমস্যা
প্রথমেই বলা হয়েছে যে, রাগ একটি সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক আবেগ বা ইমোশন, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। রাগ যেমন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় তেমনি তা নানা প্রকার মানসিক সমস্যার ক্ষেত্রেও দেখতে পাওয়া যায়। ঘনঘন ও প্রচণ্ড রাগের সাথে মানসিক সমস্যার পরস্পর যোগসূত্রতা বা সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। কেউ হয়তো বেশি আবেগপ্রবণ, আবার কেউ কেউ অস্বাভাবিক নীরব-পানসে, কোনো কিছুতেই কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখায় না। আবেগপ্রবণতা বা নির্লিপ্ততা কমবেশি হয়তো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মধ্যেও দেখা যায়। কিন্তু ঘটনার প্রতিক্রিয়া তখনই বোঝা যায় যখন ঘটনার সাথে অতিরিক্ত আবেগের প্রকাশ বা অপ্রকাশের কোনো প্রাসঙ্গিক সম্পর্ক বা কারণ থাকে না এবং যেখানে আবেগের প্রকাশ হয় তীব্র এবং নীরবতাটাও হয় অস্বাভাবিক এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তা হয় সামঞ্জস্যবিহীন। এ ধরনের অকারণ তুচ্ছ ব্যাপারে হঠাৎ রেগে গিয়ে-
  • অন্য লোককে যখন-তখন আক্রমণ করে বসতে পারে
  • ক্রোধান্বিত বা রাগান্বিত হয়ে হঠাৎ উঁচু স্থান থেকে লাফ দিয়ে পড়ে হাত-পা ভাঙতে পারে
  • আবার নিজেকে আঘাত করতে পারে
  • অন্যকেও ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে পারে
আর এদের এ রকম আচরণের আগাম হদিসও পাওয়া যায় না বা বোঝা যায় না যে অন্যের কাছে এরা কখন মারাত্মক, বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। মানসিক সমস্যায় রাগের বহিঃপ্রকাশ দারুণভাবে লক্ষ করা যায়। নানা প্রকার মানসিক সমস্যায় রাগের মাত্রাও নানা গতির, নানা প্রকৃতির হয়ে থাকে।
অনেকের ধারণা, মানসিক রোগী মাত্রই সব সময় বিপজ্জনক এবং সব সময়ই এরা উত্তেজিত বা রাগান্বিত হয়ে অন্যদের আক্রমণ করে বসে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এ ধরনের প্রচণ্ড রাগী মনোভাব মানসিক রোগীদের বেলায় অপেক্ষাকৃত কদাচিৎ দেখা যায়। সাধারণত দুটি কারণে মানসিক রোগীদের মধ্যে আক্রমণাত্মক ভাব ও প্রচণ্ড রাগের উদয় হয়-
  • একটি হচ্ছে, ভ্রান্ত ধারণা বা ডিলিউশন-এর বশে রোগী মনে করে যে অন্য লোক তার ক্ষতি করবে, তাকে মেরে ফেলবে, তখন সেই কাল্পনিক শত্রুকে প্রতিহত করতে কখনো কখনো তারা প্রচণ্ড মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
  • অন্যটি হচ্ছে মানসিক অসুখের কারণে উদ্ভট, আজগুবি সব  চিন্তা-ভাবনার বশে রোগীর মনে হয় যে সে বুঝি নিজেকে আপন আয়ত্তে রাখতে পারবে না, তাই এ কারণে সে হয় নিজের নয়তো অন্যের ক্ষতি করে ফেলবে-এ দ্বিধা তাকে পেয়ে বসে।
এসব উগ্র-উত্তেজিত, রাগান্বিত, ক্ষুব্ধ রোগীদের হাবভাব দেখে তাদের আপনজন এবং প্রতিবেশীরাও ভয় পেয়ে যান। তাই কখনো কখনো ঘরের মধ্যে রোগীকে আটকে রাখেন, কখনো বা তালা দিয়ে আটকে রাখেন, যাতে এরা নিজেদের এবং অন্যদের কোনো প্রকার ক্ষতি বা বিপদ ঘটাতে না পারে।
উত্তেজিত অবস্থায় রোগী যা করে তার পরিণাম বিচারের ক্ষমতা তখন তার মধ্যে থাকে না, উত্তেজনাকর সময় রোগীর মধ্যে প্রবল শক্তি দেখা গেলেও ক্রমে ক্রমে এরা আহার-নিদ্রার অভাবে শক্তিহীন হয়ে পড়ে।
নানা রকম মানসিক ব্যাধিতে এ ধরনের অনাকাঙিক্ষত পরিস্থিতির উদ্ভব হতে দেখা যায়। যেসব মানসিক রোগে এ ধরনের অনাকাঙিক্ষত ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে দেখা যায়, যেসব মানসিক অসুখে এবং অবস্থার মধ্যে রোগীর প্রচণ্ড রাগ-উত্তেজনা দেখা যায় তা পাঠক/পাঠিকাদের বোঝার সুবিধার্থে সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করা হলো-
শরীরভিত্তিক নয় এমন কঠিন মানসিক রোগ যেমন-
  • সিজোফ্রেনিয়া
  • ম্যানিয়া
  • বিষণ্নতা
  • বাইপোলার ডিসঅর্ডার
  • ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডার ইত্যাদি এরকম মনোব্যাধিতে প্রচণ্ড মাত্রার রাগের সৃষ্টি হতে পারে। এই রোগগুলো সাধারণত হঠাৎ করে হয়ে যায় না, একটু খোঁজ-খবর নিলেই দেখা যাবে যে এসব রোগের অন্যান্য উপসর্গ বা লক্ষণ-ইঙ্গিত আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, পরিবারের সদস্য বা অন্যরা হয়তো তা বুঝতেই পারেনি।
  • শরীরভিত্তিক তীব্র স্বল্পস্থায়ী মানসিক ব্যাধি-এসব রোগে প্রচণ্ড রাগ ছাড়াও স্থান-কাল এবং পাত্রের জ্ঞান লুপ্ত হয় এবং চেতনার অবনতি ঘটে।
  • নানা প্রকার মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এবং মদ্যপানের ফলে উচ্ছৃঙ্খল ও রাগান্বিত অবস্থা দেখা দিয়ে থাকে।
  • এপিলেপসি বা মৃগীরোগীদের ফিটের পরিবর্তে অথবা ফিটের অব্যবহিত পরে কখনো কখনো প্রচণ্ড উন্মত্ত রাগ দেখা যায়।
  • হিস্টিরিয়া রোগেও কোনো কোনো সময়ে ব্যক্তির বিশৃঙ্খলভাব ও প্রচণ্ড মাত্রার রাগান্বিত অবস্থা লক্ষ করা যায়।
প্রচণ্ড রাগান্বিত-উত্তেজিত রোগীর বেলায় করণীয়
রোগীর রাগ-উত্তেজনা এবং হিংসাত্মক মনোভাব বা টেনডেন্সিকে অধিক শক্তি প্রয়োগের দ্বারা মোকাবেলা করা অনুচিত ও বিপজ্জনক। কারণ এতে রোগীর রাগ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে তার ক্লান্ত-অবসন্নভাব বেড়ে গিয়ে চরম ক্ষতি বা মৃত্যু পর্যন্তও ঘটে যেতে পারে। এসব রোগীকে সংযত করার জন্য অধিক পরিমাণ শান্ত করার ওষুধ বা ‘সেডেটিভ’ দেয়া ঠিক নয়। এসব রোগীর প্রতি সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পাল্টা ক্রুদ্ধ বা রাগান্বিত হয়ে কোনোভাবেই এদের ওপর শারীরিক নির্যাতন ও মানসিকভাবে অবমাননা করা মোটেই ঠিক নয়। এটা মমতা বা মানবতাবহির্ভূত কাজ। এসব রোগীর বাইরে তীব্র রাগ-রাগভাব থাকলেও মনে মনে কিন্তু এদের প্রচণ্ড ভয় বা ফোবিয়া লুকিয়ে থাকে; সে জন্য সাবধানে সাহসের সাথে রোগীর আত্মমর্যাদাকে যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রেখে তাকে আশ্বস্ত করতে হবে এবং তাকে বোঝাতে হবে যে সব বিষয়েই তাকে যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করা হবে। যাতে কোনোভাবেই কেউ তার ক্ষতি করতে না পারে। এসব সান্ত্বনা দান ও আশ্বাস অনেক সময় ‘ম্যাজিকের মতো’ কাজ করে। তবে যদি নিরুপায় হয়ে রোগীকে বাঁধতেই হয়, তাহলে শক্ত দড়ি দিয়ে এ কাজ কখনোই করা উচিত নয়, তা অমানবিকও বটে। এক্ষেত্রে নরম কাপড় দিয়ে এমনভাবে তাকে বাঁধা দরকার যাতে শরীরে কোথাও আঘাত না লাগে অথবা রোগীর শরীরে রক্ত চলাচলে কোনো রকমের ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়। কিন্তু এরপর যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি রোগীকে ওষুধ প্রয়োগ করে শান্ত করে, সান্ত্বনা ও আশ্বাস দিয়ে বাঁধন খুলে দিতে হবে। ক্রুদ্ধ-উত্তেজিত রোগীর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র অথবা অন্য কোনো মারাত্মক অস্ত্র থাকলে অবশ্যই বন্ধু-বান্ধব ও পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। প্রচণ্ড রাগান্বিত রোগীকে শান্ত করার যে সমস্ত ওষুধ সবচেয়ে নিরাপদ এবং নিশ্চিত ফলপ্রদ সেগুলো হচ্ছে-
  • ডায়াজিপাম
  • হ্যালোপেরিডল এবং
  • ক্লোরপ্রোমাজিন
ডাক্তারের পরামর্শে উপযুক্ত ডোজে এই ওষুধগুলোর ইনজেকশন দিলে অল্প সময়ের মধ্যেই রোগীর রাগান্বিত, ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত অবস্থাকে আয়ত্তে আনা সম্ভব হবে। তবে এই ধরনের ওষুধগুলো মুখে ট্যাবলেট আকারে খাওয়া সম্ভব হলে সেটাই প্রথমে চেষ্টা করে দেখা ভালো। ওষুধ প্রয়োগ করতে হলে মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্য নেয়া অবশ্যই প্রয়োজন।
যেখানে মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রোগীকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাওয়া সম্ভব সেখানে নিয়ে গিয়ে দরকার ক্ষেত্রে ইসিটি বা ইলেকট্রিক শক থেরাপি প্রয়োগ করলে অতি শিগগিরই রোগীর চরম রাগ ও উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে আসবে।
জানার মতো কথা হলো, প্রবল ক্রুদ্ধ রোগীকে অনেক সময় ধরে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হলে তার শরীরে লবণ ও জলের অভাবের ফলে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এসব রোগীর রাগ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ছাড়াও উপযুক্ত অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে তার অস্বাভাবিক ও প্রচণ্ড রাগের সঠিক কারণ নির্ণয় করে বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
রাগ দমনে সুস্থ মানুষও কি অসুস্থ হয়ে যেতে পারে? রাগের মতো জরুরি আবেগটি যাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রকাশ না পায় সে জন্য আমেরিকান মনোচিকিৎসক ডা. চার্লস স্পিলবার্গার রাগের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশভঙ্গির কথা উল্লেখ করেছেন। তার গবেষণায় তিনি বলেছেন, রাগকে পুরোপুরি চেপে রাখা যাবে না, একেবারে দমন করাও যাবে না। কারণ অবদমিত রাগ থেকে জন্ম হতে পারে নানা রকম মানসিক রোগ ও শারীরিক সমস্যা, হতে পারে-
  • বিষণ্নতা
  • উদ্বিগ্নতা
  • স্ট্রেস বা মানসিক চাপ
  • খিটখিটে মেজাজ
  • সবকিছুর সমালোচনার মনোভাব এবং
  • উচ্চরক্তচাপ
এছাড়া অবদমিত রাগের কারণে তৈরি হতে পারে সব সময় অন্যের পেছনে লেগে থাকার মতো বাজে রোগ বা প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ বিহেভিয়ার নামক জটিল আচরণগত মানসিক বৈকল্যের। এ সমস্যাতে আক্রান্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তির সামনা-সামনি মোকাবিলা না করে অযাচিতভাবে অন্যের পেছনে লেগে থাকার অভ্যাস গড়ে ওঠে।
রাগের প্রকাশভঙ্গি কেমন হওয়া দরকার?
রাগের প্রকাশ হতে হবে-
  • গঠনমূলক
  • দৃঢ় কিন্তু
  • আক্রমণাত্মক বা অ্যাগ্রেসিভ নয়
যা কিছু চাওয়ার তা চাইতে হবে অন্যকে আঘাত না করে বা কষ্ট না দিয়ে আর যা কিছু চাওয়ার নয় তা বর্জন করতে হবে অন্যের প্রতি সম্মান রেখে। যে বিষয়টি নিয়ে রাগ হচ্ছে সেটিকে কেবল নিজের দিক থেকে না দেখে অন্যদিকে ঘুরিয়ে আনতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি। আর তাতে করে বিষয়টি উপস্থাপিত হতে পারে ভিন্নমাত্রায়, বদলে যেতে পারে আপনার রাগের প্রকাশভঙ্গি। বদলে যেতে পারে আপনার জীবন। সেই সঙ্গে নিজের ভেতর নিয়ে আসতে হবে-
  • স্থিরতা
  • যুক্তিগ্রাহ্যতা
যা কেবল মানসিক শক্তিই আনবে না বরং সেই সাথে বিষণ্নতা বা উচ্চরক্তচাপের মতো জটিল রোগ থেকে রক্ষা করবে। রাগ অনেক ক্ষেত্রেই দমন করা যায় বা এড়িয়ে চলা যায় এবং তার গতি ভিন্নখাতেও প্রবাহিত করা যায়। কোনো ব্যক্তি বা বস্তু যদি রাগের কারণ হয় তবে তার সম্পর্কে না ভেবে অন্য কিছু গঠনমূলক বিষয় নিয়ে চিন্তা করলে রাগকে এড়িয়ে চলা যেতে পারে। ভালো কোনো সুন্দর দৃশ্য, আপনার প্রিয়জনের কথা মনে করতে পারেন। আপনার আলাপচারিতার সময় ‘কখনোই না’ বা ‘সব সময়ই’ এ জাতীয় শব্দচয়ন পরিহার করুন। পজিটিভ ভঙ্গিতে কথা বলার অভ্যাস করলে কেবল নিজের রাগকে যে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাই নয় বরং আশপাশের মানুষজনও রাগ করার কারণ খুঁজে পায় না।
আমেরিকার ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের একটি গবেষণাপত্রে রাগ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কর্মজীবী মা চাকরি থেকে ঘরে ফেরা মাত্রই তার কোলে ক্রন্দনরত শিশুটিকে যেন তুলে দেয়া না হয়, মাকে অন্তত ১৫ মিনিট সময় দিন, নিজের জন্য তাকে কিছু সময় দিন এরপর শিশুকে তার কাছে দিন। দেখা গেছে, মাকে এ সময়টুকু দিলে মায়ের যে কোনো বিষয়ে রাগ করার প্রবণতা অনেক কমে এসেছে।
রাগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যাবে না, আর তা সুস্থ মন ও শরীরের জন্য উপযোগীও নয় বরং রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘কন্ট্রোলিং অ্যাংগার বিফোর ইট কন্ট্রোলস ইউ’ অর্থাৎ রাগ আপনাকে কন্ট্রোল করার আগে রাগকে আপনি কন্ট্রোল করুন।
কোনো কোনো মনোবিজ্ঞানী রাগ প্রকাশ হতে দেয়াকে ভয়াবহ যুক্তি বলে মনে করেন, অনেকেই এই তত্ত্বকে রাগের বৈধ লাইসেন্স দেয়া মনে করেন এবং গবেষকগণ দেখেছেন যে, রাগকে সহজাত ভঙ্গিতে প্রকাশ হতে দিলে কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না বরং রাগে উত্তেজনাপ্রবণতা আরো বেড়ে যায় এবং তা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়। তাই রাগের সঠিক কারণ অনুসন্ধান করে তার সঠিক সমাধানের পথ খুঁজে বের করা হবে উত্তম কাজ।
রাগের সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ কৌশল
রাগ ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হলো রাগ সৃষ্টিকারী আবেগানুভূতি ও মানসিক উত্তেজনার সুষ্ঠু শাসন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে রাগ বা বিরক্তি উদ্রেককারী ব্যক্তি বা বস্তু হতে আমরা সব সময় মুক্ত নই বা এগুলোকে পরিহারও করতে পারি না। সুতরাং এক্ষেত্রে সম্ভব যা করা যায় তা হলো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। রাগী ব্যক্তিরা সাধারণত-
  • উচ্চস্বরে কথা বলে
  • অযথা চিৎকার, চেঁচামেচি করে
  • একটুতেই অভিমান করে বসে
রাগী ব্যক্তিরা সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি ও নাটকীয় ভঙ্গি ভঙ্গিমা করে থাকে এবং চিন্তা-ভাবনায় ও এদের নাটকীয় পরিবর্তন আসে। রাগ নিয়ন্ত্রণে যৌক্তিক চিন্তা বিশেষ সহায়ক হয়ে থাকে। মনে রাখার মতো কথা হলো, যুক্তির কাছে রাগ সব সময়েই পরাজিত হয়। কাজেই ভাবনা-চিন্তায় সব সময় যৌক্তিক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
জগৎ সংসারে আমরা সব সময়ই কোনো না কোনো বৈরী পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্মুখীন হই। কাজেই এসব বৈরী পরিবেশ থেকে রাগান্বিত না হয়ে বরং যুক্তিসহকারে বা গঠনমূলকভাবে তা মোকাবিলা করলে রাগে স্থিতিশীলতা ও নিয়ন্ত্রণ আসবে। এছাড়া আকাঙক্ষা সম্পর্কে সচেতন হওয়া অপরিহার্য।
যা চাই তা পেতেই হবে-এ ধরনের মনোভাব অবশ্যই পরিত্যাগ করে যা পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট হওয়ার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। কোনো কিছু না পেলে হতাশ হওয়া বা দুঃখ পাওয়া স্বাভাবিক কিন্তু তাই বলে তার কারণে বোকার মতো রাগান্বিত হওয়া নিতান্তই অযৌক্তিক ও অবুদ্ধিমানের কাজ। রাগী ব্যক্তিরা সাধারণত চট করে ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নেয়, যা প্রায়ই তার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই কিছুটা সময় নিয়ে ধীরস্থিরভাবে ঠান্ডা মাথায় যৌক্তিক চিন্তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত এবং সেই সাথে অন্যের মতামতের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হওয়া দরকার। অনেকেই রাগকে আত্মতুষ্টির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করলেও আসলে কিন্তু তা প্রকৃত অর্থে আত্মতুষ্টি বয়ে আনে না। রাগ নিয়ন্ত্রণে কোনো কিছু অপছন্দনীয় হলে বা তা রাগের কারণ হলে সেটাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম। রাগের সময়-
  • আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলা
  • হাল্কা কিন্তু নিয়ন্ত্রিত রসিকতা
  • সুন্দর বই-পুস্তক পড়া
  • পত্রিকা বা ম্যাগাজিন পড়া ও
  • পছন্দমতো সুন্দর সুন্দর কল্পনা করা রাগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে থাকে
রাগ করা ভালো নয়
তাই বলে সম্পূর্ণরূপে নির্জীব থাকতে হবে? না এটাও স্বাভাবিক নয়। কারণ রাগ না থাকলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। রাগ না থাকলে কোনো দুষ্ট ব্যক্তি বা হিংস্র পশুও শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা যাবে না। আর এই ব্যর্থতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবননাশের কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার কোনো শত্রু দেশ আক্রমণ করলে তখন রাগ-উত্তেজনার সৃষ্টি না হলে নিজের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করাও সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। আবার রাগ না থাকলে নিজের প্রাপ্য অধিকারও আদায় করা যাবে না। তবে এ জাতীয় বিশেষ কিছু ব্যতিক্রম ব্যাপার ছাড়া রাগ সব সময়ই কাম্য হতে পারে না বা কাম্য হওয়া উচিতও নয়। রাগ সমাজের সেসব মারাত্মক অন্যায়ের অন্তর্ভুক্ত, যা মানুষের ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠিত জীবনকে ধ্বংস করে দেয়, রাগ একটি সর্বনাশা ব্যাপার। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নির্দেশ করেছেন যে, ‘রাগ অবস্থায় যদি দাঁড়ানো থাক তাহলে বসে যাও, বসা অবস্থায় থাকলে শুয়ে পড়, যদি এতেও রাগ ঠান্ডা না হয় তবে পানি পান করে নাও’।
আমেরিকায় ডিউক ইউনিভার্সিটির একজন বিজ্ঞানী রেড ফোর্ড বি ভিলমজের মতে, রাগ-শত্রুতা এবং হিংসাকারী ব্যক্তিরা তাড়াতাড়ি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাদের মতে, রাগের দ্বারা মানুষ এ পরিমাণই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধূমপান ও হাইব্লাডপ্রেসারের কারণে। মহানবী (সা.) বলেন, ‘হে মুসলমানেরা! যদি তোমাদের মধ্যে কারো রাগ আসে তাহলে তার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে চুপ হয়ে যাওয়া জরুরি।’ তিনি আরো বলেন, ‘রাগ থেকে বিরত থাক, রাগ কোরো না, কারণ তা বিবাদের সৃষ্টি করে।’ তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘মল্লযুদ্ধে শত্রুকে পরাজিত করার মধ্যে প্রকৃত বীরত্ব নেই, রাগের সময় আত্মসংযমের মধ্যেই প্রকৃত বীরত্ব।’
যদি কারো রাগ হরহামেশাই বাড়তে থাকে এবং তা যদি ব্যক্তির নিজের বা অন্যের জন্য অসহনীয় হয়ে যায় তাহলে যথা শিগগির সম্ভব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া ও প্রয়োজনে চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর ডাক্তারের কাছে আপনার রাগের ছোট, বড় সব কারণই খোলা মনে বলতে হবে। কোনো কারণ বা রাগানুভূতি লজ্জায় লুকিয়ে রাখলে চলবে না। মনে রাখতে হবে ডাক্তার আপনার বন্ধুর মতো, তাই তার কাছে নিরাময়ের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য জানাতে হয়। এতে লজ্জা-শরম বা অপমানের কিছু নেই।
আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, হতে হবে সংযমী। আমরা রাগকে পুরোপুরি জয় করতে না পারলেও তাতে লাগাম দেয়ার চেষ্টা তো অবশ্যই করতে পারি। আর এই চেষ্টার ফলে যদি রাগ প্রশমিত হয়ে আসে তাহলে তো কোনো কথাই নেই; আমাদের জীবন তখন হয়ে উঠবে সুখী-সুন্দর ও নির্মল। এতে করে মন-প্রাণ সুন্দরের সৌরভে ভরে যাবে, ছেয়ে যাবে শান্তি, সৌরভ, সুন্দরতায়, মধুরতায়।
নেট থেকে 

2 comments:

  1. ami amar rag control korte chai kintu pare na r onek somoy onek choto karoneo ami onek boro bhul shiddhanto nei ja pore amr khotir karon hoi pls amak ar shomadhan den

    ReplyDelete
  2. amio amar rag control korte pare na onek try kori rag na korar jonno kintu ashole hoi na onek somoy rager mathai ami onek boro bhul shiddhanto niye fale ja kore felar por ami bujhte pare je ota onek boro khotikor o marakhtok bhul kaj chilo ashole ami kivabe amr rag control korbo jani na pls amk ar shomadhan bole den.

    ReplyDelete