Thursday 22 August 2013

মাদক: সময় থাকতে সাবধান

দেশের টিনএজদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই এখন মাদকে আসক্ত। রাজধানী ঢাকায় এই সংখ্যা আতঙ্ক জাগানোর মতো। ৫ থেকে ৭ লাখ। এদের অর্ধেকই টিনএজ। এরা বলছেন, হতাশা, পরিবারের অমনোযোগিতা, অসৎ সঙ্গ এবং নতুন অনুভূতি লাভের আশায় তারা ঝুঁকছেন মাদকে। এ জন্য নিজেদের চেয়ে পরিবার বেশি দায়ী বলে দাবি করেন তারা। চিকিৎসকরাও সমর্থন দিয়েছেন তাদের কথায়। বলছেন- হ্যাঁ, পরিবারের কারণেও অনেকে মাদকে আসক্ত হচ্ছে। সন্তানের প্রতি অমনোযোগিতা, তারা কার সঙ্গে মিশছে, কি করছে, কাদের সঙ্গে চলাফেরা করছে এসবের খোঁজ রাখে না অনেক
পরিবার। পাশাপাশি জোর করে নিজের মত সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেয়া কিংবা তার নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে না দেয়াও প্রভাব ফেলছে। 

মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘মুক্তি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আলী আসকার কোরেশী বলেন, প্রথমত মাদকাসক্ত বন্ধুদের মাধ্যমে টিনএজরা আসক্ত হতে শুরু করে। সিগারেট থেকে শুরু হয়ে এক সময় সব মাদকদ্রব্যই ব্যবহার করে আসক্ত ব্যক্তি। অনেকে হতাশা ও পরিবারের অশান্তি থেকে মাদক ধরে। কাউকে বিশ্বাস করতে না, নিজেকে গুরুত্বহীন ভাবা- এসব প্রভাবিত করে কাউকে কাউকে। ওই কেন্দ্রের এক মাদকাসক্ত বলেন, আমি বুঝতাম এটা খারাপ। জানতাম, এর কারণে আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমার নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। এসব ভাল করেই জানতাম। কিন্তু হতাশা, ভেতরের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতেই মাদক ধরি। মাদক আমাকে আশ্রয় দিয়েছে। বিনিময়ে আমার সুস্থ জীবনকে ধ্বংস করেছে। এখানে সাময়িক সুখ পেয়েছি। মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এটা আসলে মুক্তি নয়। মৃত্যু। এর নাম, সুস্থ ও সুন্দর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই এটা হচ্ছে। তাদের মতে, আমাদের টিনেজরা অধঃপতনের কোন পর্যায়ে আছে তা নিষ্ঠুরভাবে হলেও জানিয়ে দিয়েছে পুলিশ অফিসারের ১৬ বছরের মেয়ে ঐশী রহমান। 


এক মাদকাসক্ত তরুণের জবানবন্দি: মাছুম (ছদ্মনাম)। বয়স ৩৩। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে বাসা। ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর দ্বিতীয় ছেলে। সেবা নিচ্ছেন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র-মুক্তি থেকে। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো নিরাময় কেন্দ্রে এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। গতকাল বিকালে কথা হয় তার সঙ্গে। জানান, ১৫ বছর বয়স থেকে মাদক ধরেছেন তিনি। কেন ধরেছেন? বলেন মাদক সেবন শুরু করি একরকম ফ্যান্টাসি থেকে। মনের ভেতরে কৌতূহল এবং আগ্রহ থাকার কারণে ঝোঁক বাড়ে। বাবাকে ছোটবেলা থেকে হুইস্কি খেতে দেখেছি। মূলত সেখান থেকেই ঝোঁক। তবে এর পেছনে আছে আমার প্রতি পরিবারের অবহেলা। জানি না কেন, কিন্তু একরকম দূরত্ব তৈরি হয় বাবা-মায়ের সঙ্গে। যদিও বাবা-মা আমাকে ভালবাসে। দেশের বাইরে অসংখ্যবার আব্বু ঘুরতে নিয়ে গেছে। নবম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় মাদক ধরি। প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ বোতল মদ ছাড়া আমার চলতো না। বাবা ঢাকা শহরের বড় ব্যবসায়ী। ফুটপাথের দোকানদার থেকে ঢাকার নামী ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হয়েছেন তিনি। বিলাসবহুল গাড়ি তখন চালাতাম আমি। যখন বারিধারার একটি স্কুলে পড়ছি তখনই বন্ধুদের নিয়ে মাদকে জড়িয়ে পড়ি। একটি প্রেমের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ায় এই আসক্তি আরও তীব্র হয়। তখন ১৯৯৫ সাল। এর ফলে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনাটাও হয় না। আমার কাছে সেই সময় মানে, সকাল সাড়ে ৭টায় বাসা থেকে বের হও, স্কুলের সামনে যাও, ক্লাস কামাই করো, বন্ধুদের পিকআপ দাও আর ঘুরে বেড়াও- ইত্যাদি। যখন বেশি টাকা লাগতো তখন বাসা থেকে না বলে চুরি করতাম। পরিবারও যে আমাকে খুব বেশি বাধা দিয়েছে তা-ও নয়। যেখানে পরিবারের প্রধান হুইস্কি খান সেখানে আমাকে করে বলার সুযোগ হয়তো হয়নি। আমি রাতে ফিরতাম বাড়িতে। সকালে বেরুতাম। খাওয়া-দাওয়ার প্রতি বিরক্তি জাগে। প্রথমে হুইস্কি দিয়ে শুরু। তারপর সিগারেট। শুধু ইনজেকশন ছাড়া এমন কোন মাদকদ্রব্য নেই যা আমি স্পর্শ করিনি। প্রথমে এটাকেই মনে হয়েছে ভাল জীবন। এরচেয়ে ভাল জীবন হতে পারে না। কিন্তু আস্তে আস্তে টের পেয়েছি আসলে এটা কি! মাছুম বলেন, বারিধারার স্কুল থেকে ৯ম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় স্কুল পাল্টিয়ে কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে প্রথম দিনই ক্লাসে রেগিংয়ে সহপাঠীদের একজনকে সালাম না দেয়ায় থাপ্পড় মারে। এ কারণে রেগে বাসা থেকে বাবার লাইসেন্স করা ৪.৩২ মডেলের পিস্তল নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে স্কুল পাল্টাতে হলো। ইংলিশ মিডিয়াম থেকে গেলাম বাংলা মিডিয়ামে- মতিঝিল আইডিয়ালে। তবে পড়া আর হলো না। শেষ ব্রেঞ্চের ছাত্র হয়ে গেলাম। ড্রাগ নেয়ার কারণে আমার স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকলো। পড়াশোনা শেষ। স্কুল ঘন ঘন পরিবর্তন করায় বন্ধুও আমার সে রকম থাকলো না। একাকিত্ব আমাকে পেয়ে বসে। বাসায় ভাল লাগে না। বাইরে বন্ধু নেই। কিন্তু আমি এমন না। বুঝতে পারি। আবার চারপাশে মনের মতো মানুষের অভাব। ক্লাস টেনের পর বাবা ব্যবসায় ঢুকান। তখন কাজ করলেও সবাই সন্দেহের চোখে দেখে। আমিও কাউকে যেন বিশ্বাস করতে পারি না। তারাও যেন আমাকে বুঝতো না। বিশ্বাসও করতো না। এটি আমাকে পীড়া দিতো। ফলে আস্তে আস্তে আমি মাদকের জালে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। 


বিশেষজ্ঞের মত: ডা. আলী আসকার কোরেশী বলেন, ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সের মধ্যে ৫০ শতাংশই এখন মাদকের ছোবলে আক্রান্ত। অভিজাত পরিবারের টিনএজরা শখের বসে ঝুঁকছে। এদের বেশির ভাগই বন্ধু-বান্ধবদের পাল্লায় পড়ে জড়িয়ে যাচ্ছে মাদকের অন্ধকার জগতে। গ্রামেও কম নয় মাদকসেবীর হার। সেখানে ফেনসিডিল, গাঁজা ও বাংলা মদের দিকে ঝোঁক বেশি। এখন যুক্ত হয়েছে ইয়াবা। সহজলভ্য হয়ে ওঠায় এটা গ্রাস করছে শহরের বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে পড়ুয়া তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ মানুষ। এ অবস্থায় অভিভাবকরা যখন উপায় না থাকে তখনই চিকিৎসক বা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের শরণাপন্ন হন। তারা চান ঘরে বা পারিবারিক ভাবেই বিষয়টির সমাধান করতে। কিন্তু এটি অত্যন্ত কঠিন। কেউ আবার সামাজিক অবস্থানের ভয়ে বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার করেন না। তাই মা-বাবা বা পরিবারের সদস্যরা জানলেও তাদের আসক্ত সন্তানকে সেবার আওতায় নিয়ে আসছেন না। 

ঐশীর বাবা-মা এ বিষয়টিকে এড়িয়ে গিয়ে নিজেরা কঠোর ভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেছিলেন বলে হিতে বিপরীত হয়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে একটি সুন্দর পরিবার। তিনি বলেন, সন্তান মাদকাসক্ত প্রথমে অভিভাবকরা এটি বুঝতে পারেন না। আর অনেকে বিষয়টি বোঝার যে চেষ্টা করেন তা-ও কিন্তু নয়। তবে যখন তাদের মনে হয় যে সন্তান মাদকে আসক্ত তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। অভিভাবকদের উচিত যখনই টের পাবেন তখনই চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। তা না হলে এটি তাকে ধ্বংস করে দেবে। মেধাবী শিক্ষার্থী হলে তার কেরিয়ার একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর উপার্জনকারী হলে তার আর অর্থ সাশ্রয়ের কোন সুযোগ থাকবে না। সে পরিবারের স্বাভাবিক বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। 

বর্তমানে ঢাকার সব মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে সিট খালি নেই বললেই চলে। সাইকেল রোগীও আসছেন প্রায়শই। দীর্ঘ দিন সেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে পরিবারের মাঝে ফিরে আবার আসক্ত হয়ে ফিরছে কেন্দ্রে- এদের সংখ্যাও কম নয়। নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে সর্বনিম্ন ৪ সপ্তাহ থেকে ৪ মাস পর্যন্তও কারও কারও সেবা নিতে হয়। তিনি জানান, যারা আসেন তারা ভাল হয়েই বের হন। এর আগে তাদের ছাড়া হয় না। 
কিন্তু সমস্যা হয় পরিবেশ ও সঙ্গদোষের কারণে তাদের অনেকে ফের আক্রান্ত হন মাদকে। এর হারও উল্লেখযোগ্য। যারা আবার সেবা নিতে ফিরে আসেন তাদের অর্ধেকই তাড়াতাড়ি আসক্তিতে জড়িয়ে পড়েন। এমনও হয় ৩ থেকে ৪ বারও আসতে হয় কাউকে। আমাদের মনে রাখতে হবে নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসাই শেষ নয়। এটাকে শুরু ভাবতে হবে। সেবা নেয়া শেষে শুশ্রূষার শুরু হয়। এটা দীর্ঘ দিনের জন্য সেবার প্রয়োজন। পাশাপাশি কাউন্সেলিং প্রয়োজন। তাই মাদক একেবারে ভুলে না যাওয়া পর্যন্ত অন্তত প্রতি সপ্তাহে একবার আসক্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। 

সৌজন্যঃ মানবজমিন

No comments:

Post a Comment