আকস্মিক দুর্ঘটনার পর কারো কারো ক্ষেত্রে তীব্র মানসিক প্রতিক্রিয়া হয় যা জীবন যাপনকে ব্যাহত করে এবং মানসিক রোগের পর্যায়ে চলে যায়। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে মাসখানেকের মধ্যেই তীব্র মানসিক চাপজনিত সমস্যা (একিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার) কমে আসে। তবে, কারো কারো ক্ষেত্রে এই সমস্যা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। অথবা, প্রাথমিকভাবে কোন সমস্যা না হলেও পরবর্তীতে এই দুর্ঘটনার সূত্র ধরেই মানসিক অসুস্থতার শিকার হতে পারেন অনেকে। একে চিকিৎসার পরিভাষায় ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ (পিটিএসডি) বলা হয়। দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো দুর্ঘটনার গন্ডি ছাড়িয়ে বড় কোন দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এ রোগ হয়ে থাকে। ‘সাভার ট্র্যাজেডি’ তেমনি হৃদয়বিদারক একটি দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনার শিকার অর্থাৎ ভবন ধসে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিরা যেমন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, তেমনি উদ্ধার-কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী, এমন
কি সংবাদ সংগ্রহের জন্য খুব কাছ থেকে এই ভয়াবহতা অবলোকন করা সাংবাদিকরাও এ রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক চাপের উপসর্গগুলো ব্যক্তির জন্য প্রবল যন্ত্রণাদায়ক। এই সব উপসর্গ ব্যক্তির জীবন যাপনকে দুর্বিষহ করে তোলে। ভয়ংকর দুর্ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি বারে বারে ফিরে আসে। ঘটনার সাথে সম্পর্কযুক্ত কোন শব্দ, দৃশ্য বা আলোচনা ব্যক্তির মনে সে স্মৃতি জাগিয়ে তুলতে পারে। রাতে দুঃস্বপ্নেও হানা দিতে পারে সেই স্মৃতি। ব্যক্তি একই রকম ভয়, আতংক, বেদনা অনুভব করতে পারেন, যেমন অনুভুতি হয়েছিল প্রকৃত ঘটনাটির সময়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ‘সাভার ট্র্যাজেডি’র শিকার আহত ব্যক্তি সামান্য শব্দেই চমকে উঠছেন, ভবন ভেঙে পড়ছে – এমন চিৎকার করে ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন – এমন সংবাদ পত্রিকাতেই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
পিটিএসডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক সময় বেদনাদায়ক পরিস্থিতিটি মনে করিয়ে দিতে পারে এ ধরণের ঘটনা, ব্যক্তি বা আলোচনা এড়িয়ে চলেন। লোকজনের সাথে মেলামেশা কমিয়ে দেন। অনেকে আবার ভয়াবহ দুর্ঘটনাটির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ভুলে যান অজান্তেই।
কেউ কেউ আবার হয়ে পড়েন অস্থিরচিত্ত। সব সময় যেন বিপদাশংকায় মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক থাকেন। কোন কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না, ঘুম কমে যায়। অনেকের ক্ষেত্রে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা বা ম্যাজ ম্যাজ করা, বুক ধড়ফড় করা, হাত-পা কাঁপা, খাওয়ায় অরুচি প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দেয়। অনেকে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হন, প্রত্যক্ষদর্শীরা দুর্যোগ থেকে অন্যদের বাঁচাতে না পারার জন্য অপরাধবোধে ভোগেন। আক্রান্তদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয় অন্যদের চেয়ে বেশী।
পিটিএসডি-তে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। এজন্য ওষুধ এবং বিশেষ কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপী- উভয়ের সমন্বয়ে চিকিৎসা করা হয়। সাইকোথেরাপীর মাধ্যমে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের ঘটনা সম্পর্কে তাদের চিন্তা-ভাবনা ও আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেয়া হয়। এছাড়া গ্রুপ থেরাপীর মাধ্যমে রোগীর মাঝে এই বিশ্বাস জন্মে যে, এই দুর্যোগে তিনি একা নন। প্রয়োজনে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ-অনুযায়ী উৎকন্ঠাবিনাশী ও বিষণ্নতারোধী ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। দুর্যোগ-পরিস্থিতির পর পরই আক্রান্ত ব্যক্তিদের খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রশিক্ষণসহ তাদের আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেয়া হলে পরবর্তীতে মানসিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।
No comments:
Post a Comment