ডিজিটাল ডিজওর্ডার হলো (অতিরিক্ত) ইন্টারনেট আসক্তি, এক মনোব্যক্তিগত ব্যাধি। বিশ্বজুড়ে স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেটে আসক্তি এখন কোন মিথ নয়, সহজ সরল এক বাস্তবতা। ‘মানসিক ব্যাধির ডায়াগনস্টিক এবং পরিসংখ্যান ম্যানুয়াল’ (DSM) অনুযায়ী কম্পিউটার গেম ও ইন্টারনেটে আসক্তি এখন যথারীতি মানসিক রোগের অন্তর্ভূক্ত। একটিকে বলা হচ্ছে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ (IGD) আর অন্যটি হলো ‘ইন্টারনেট এডিকশন ডিজঅর্ডার’ (IAD), বা ‘আইডিজঅর্ডার’ (iDisorder)। ইউরোপ ও পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশে ইন্টারনেট আসক্তির কুফল, নিরাময় ইত্যাদি নিয়ে এখন রীতিমত গবেষণা চলছে।
অ্যালেক্স বলছে, বাংলাদেশ থেকে যে দশটি সাইটে সবচে বেশী ভিজিট করা হয় তার মধ্যে রয়েছে- গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, গুগল.কম.বিডি, প্রথম আলো, ইয়াহু, ব্লগস্পট.কম, উইকিপিডিয়া, বিডিনিউজ২৪.কম, বাংলানিউজ২৪.কম। তবে আসল বিষয় হচ্ছে তালিকায় যে তিনটি সংবাদপত্র ও ইউটিউবের নাম রয়েছে
সেখানে অধিকাংশ মানুষ সরাসরি ভিজিট করছে না, ফেসবুক থেকে এসব নিউজ বা ভিডিও লিঙ্কে ক্লিক করে প্রবেশ করছে; অর্থাৎ, বাংলাদেশী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের সিংহভাগ সময় কাটছে ফেসবুকের পাতায় পাতায়। গ্রামীণ ফোনের এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৮০ শতাংশ মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করে।
ইন্টারনেট আসক্তিতে মনোব্যক্তিগত ঝুঁকির আশঙ্কা সবচেয়ে বেশী। এ ঝুঁকি তিন ধরণের হতে পারে-মানসিক, নৈতিক এবং শারীরিক। মানসিক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নিঃসঙ্গতা, অসহনীলতা, উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, বৈরীভাবাপন্নতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতা। ইন্টারনেট আসক্তি ফলে ব্যক্তির বাস্তব জীবনে সম্পর্কগুলো গৌণ হয়ে পড়ছে, বাস্তব জীবনের মানুষের সাথে মানুষের দূরত্ব ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ফলে বাড়ছে নিঃসঙ্গতা, নিঃসঙ্গতার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে পারস্পরিক বিশ্বাস, মানুষ অসহনশীল হয়ে পড়ছে। ইন্টারনেটের গতি একটু কমে গেলে, কোনো পেজ লোড হতে একটু দেরী হলেই আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ছি, মোবাইল ফোন ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে, কী-বোর্ড ভেঙ্গে ফেলতে মন চাইছে। আমাদের অসহনশীলতাকে পুঁজি করে ইন্টারনেট সরবরাহকারীরাও নতুন নতুন ফাঁদ তৈরী করছে- মেগা বাইট স্পিডের ফাঁদ। এ অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতায় বাড়ছে উদ্বিগ্নতা। উদ্বিগ্নতা থেকে বৈরীভাবাপন্নতা। প্রতিদিনই সেই একই কেচ্ছা, গুগল-ফেসবুক-ইউটিউব-?, ইউটিউব-ফেসবুক-গুগল-?; জীবন হয়ে পড়ছে একঘেয়েমি আর মানুষগুলো অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এছাড়া, ইন্টারনেট আসক্ত মানুষেরা অনেক সময় আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগে। ফলে দেখা যায় অনেকে নিজের পরিচয় গোপন করে ভুয়া তথ্য, ছবি দিয়ে প্রোফাইল তৈরী করে, নিজেকে অন্য কোনো খ্যাত ব্যক্তির আদলে প্রচার করে, অন্য কেউ হওয়ার ভান করে। বিষয়টি একদিকে যেমন ব্যক্তিকে বিষণ্ণ করে তোলে, ব্যক্তিত্বকে হুমকির মুখে টেনে আনে, তেমনি সামাজিক অনাচার, অপরাধ সংগঠনে সহায়তা করে।
নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ পর্নোসক্তি বা সাইবারসেক্সুয়াল আসক্তি। ফলাফল, যৌনাচরণের বিকৃতি ও যৌন নির্যাতনের হার বৃদ্ধি। ২০১৫ সালে দেশে ৩৬২টি যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে যা আগের বছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে নারী ও শিশু নির্যাতন, ব্ল্যাকমেইলও বাড়ছে। ২০১৫ সালে ৪৯টি পর্নোগ্রাফির ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। আত্মঘাতি হয়েছে অনেক তারুণ্য, যাদের অধিকাংশই নারী।
শারীরিক ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম হলো নেশাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি। রাত জেগে নেটে থাকতে গিয়ে মানুষ অতিরিক্ত ধূমপান করছে, ইয়াবা সেবন করছে। পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় তীব্র মাথাব্যাথা, খিটখিটে মেজাজ, আহারে অনিয়ম, বদহজম আমাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে। ফলে পরবর্তী দিনের একাডেমিক, পেশাগত জীবনে আসছে বিশৃঙ্খলা। দীর্ঘ সময় একনাগাড়ে বসে থাকার কারণে শরীরে মেদ জমছে, পিঠে ব্যাথা বাড়ছে ও কর্মস্পৃহা কমছে। অনেকক্ষণ স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকায় আমাদের চোখের দৃষ্টিক্ষমতার উপরে বিরূপ প্রভাব পড়ছে ।
পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাগুলোর অন্যতম আত্মকেন্দ্রিকতা ও অবৈধ শারীরিক সম্পর্কের প্রবণতা। নেটে আসক্ত ব্যক্তিরা সারাক্ষণ মোবাইল, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। দূরত্ব বাড়তে থাকে স্বামী/স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা ও অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনের সাথে।
কোনো কোনো সম্পর্ক কখনও আর ফিরতে পারে না, ঘটে বিচ্ছেদ- মানসিক বা পারিবারিক সম্পর্কের ছেদ। অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে অবৈধ্য সম্পর্ক ও পরকীয়া প্রবণতা যা বর্তমানে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সমাজে এ ধরনের সম্পর্ক এতটা সর্বগ্রাসী আগে কখনই ছিল না। কিন্তু, এখন নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ই অবৈধ্য প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। ইতোমধ্যে অনেক নারী, পুরুষ, সন্তান পরকীয়াতে বলি হয়েছে; সবচে বেশী নিহত হয়েছে নিষ্পাপ শিশুরা। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেবে ২০১২ থেকে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে দেশে ৯৬৮টি (২০৯, ২১৮, ৩১৫ ও ১৯১) শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এ বিপুল সংখ্যার শিশু হত্যার অধিকাংশের পেছনে কেনো না কোনো ভাবে পরকীয়া সম্পর্কের প্রভাব রয়েছে।
ইন্টারনেট আসক্তির ফলে বিভিন্ন দেশে সে সকল অপরাধ ও অপমৃত্যু হয়েছে তার মূলে রয়েছে ভার্চুয়াল গেম আসক্তি।উন্নত অনেক দেশই ইন্টারনেট আসক্তি নিরাময় কেন্দ্র চালু করেছে। যে সকল দেশ ইতোমধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি নিরাময় কেন্দ্র খুলেছে তাদের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, নেদারল্যাল্ডস, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান ও আমেরিকা।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট আসক্তিকে এখন পর্যন্ত রোগের তালিকায় যোগ করা হয়েছে কি না তা জানা নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড (যেমন, ঐশি, সামিউল, রাজন, মৌমি ও তায়িবা, জুনায়েদ ইত্যাদি) যেন সামাজিক অবক্ষয় বিচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ও পর্নাসক্তির প্রমান। সবচেয়ে ভয়ংকর হলো, ছয় মাস বয়েসী বাচ্চাকেও দেখা গেছে ইন্টারনেটে ইউটিউব চালু করে না দিলে বাচ্চা খাবার খাচ্ছে না।
সুতরাং সময় থাকতে সাবধান !!!
মোঃ আলাউদ্দীন ভুঁইয়া
সংকলিত
সংকলিত
ইন্টারনেট ছাড়া তো আমি কিছু ভাবতেই পারিনা।
ReplyDelete