আপনি ও মানসিক রোগ

আপনি কি একজন মানসিক রুগীর সাথে নিজেদের তুলনা করেছেন এবং মিল খুঁজে পেয়েছেন? তাতে কি আপনি মানসিক রুগি হয়ে গেলেন? কখনই না। কেননা একজন মানসিক রুগী কখনই নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। কিন্তু আপনি নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন। আমরা রাস্তায় অনেক মানসিক রোগী দেখি তাদের যা আছে যেমনঃ হাত,পা, চোখ, নাক, কান আপনার ঠিক তাই আছে; তা হলে আপনার আর ওর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? আপনার আর ওর মধ্যে পার্থক্য হলো; সে নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, কিন্তু আপনি পারছেন। মানসিক রোগ কোন ভাইরাস দ্বারা আক্রমন এর কারনে হয় না। এটি কোন ব্যাক্টেরিয়া জনিত রোগ না। এটি মানুষের মনের রোগ। 
--------------------------------------------------------------------


মানসিক রোগ কী?
আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো মানসিক রোগ। কিছুদিন আগেও সাধারণ মানুষ মানসিক রোগকে তেমন একটা আমল দিত না। এর মূলে ছিল অনেক অদ্ভুত ধারণা, অন্ধ কুসংস্কার। আজকের এই দিনে এসব কুসংস্কার ও অদ্ভুত ধারণা অচল এবং অবৈজ্ঞানিক। কিন্তু সেদিন এবং এখনো সমাজের কোনো কোনো স্তরে মানুষের মনের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা বাসা বেঁধে বসে আছে। অনেকের ধারণা, মানসিক রোগ নাকি দূষিত হাওয়া-বাতাস, দৈত্য-দানব বা জিন-ভূতের আসরে ঘটে। এ ধরনের ভ্রান্ত ও বিচিত্র বিশ্বাস মনের মধ্যে যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে শেকড় গেড়ে বসে থাকলে মানসিক রোগীর আত্মীয়-স্বজন ও পরিবার-পরিজন রোগের চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন সব সময় হন না। ধরনা দেন ফকির-ওঁঝা ও সন্ন্যাসীদের কাছে। ফলে রোগীর ওপর প্রয়োগ হয়-
তন্ত্রমন্ত্র
তুকতাক
তাবিজ
মাদুলি
পানি পড়া
ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি প্রক্রিয়া
এসব বিভিন্ন ভৌতিক প্রক্রিয়া এবং তাবিজকবচ, বালা, মাদুলি, কায়তুন পরা ইত্যাদি ধারণ করে মানসিক রোগের প্রতিকার করার বৃথা চেষ্টা করা হয়ে থাকে। এগুলো শুধু ঔদাসীন্য ও বিভ্রান্ত নয়, মানসিক রোগীর প্রতি একপ্রকার অন্যায়ও। মানসিক রোগের চিকিৎসায় আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। যার ফলে অন্যান্য রোগ সারানোর মতোই ওষুধ ও সাইকোথেরাপি এবং অন্যান্য থেরাপি দিয়ে মানসিক রোগ সারানো সম্ভব হচ্ছে।
জনসংখ্যার ১% মানুষ জটিল মানসিক রোগ ও ১০% মানুষ অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত। ৩০% মানুষের যে কোনো সময় মানসিক রোগ হতে পারে। শারীরিক চিকিৎসার জন্য যেসব রোগী বিভিন্ন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যায়, তাদের মধ্যে ৫০% রোগী মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকে। আসলে তারা যে মানসিক রোগী বা মানসিক রোগের কারণে তাদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ প্রকাশ পাচ্ছে তা কেউ বুঝতে পারছে না বা বোঝার চেষ্টাও করছে না। যা সত্যি এক দুঃখের ব্যাপার। মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্বকে সাধারণ স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্বের শামিল করতে হবে এবং সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মী আর সমাজকর্মীকে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার দায়িত্বের শামিল করা দরকার এবং সমস্ত স্বাস্থকর্মী আর সমাজকর্মীকে মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার বিজ্ঞানসমমত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। এর ফলে এরা সবাই স্বাস্থ্যের অন্যান্য বিষয়ের মতো মানসিক স্বাস্থ্য বা সাইকিয়াট্রিক্ট ইলনেস সম্পর্কে বিজ্ঞানসমমত জ্ঞান জনসমাজে প্রচার করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে তাদের পথপ্রদর্শক হয়ে বিভিন্ন রকম সাহায্য সহযোগিতাও করতে পারবেন। তবেই সমাজে প্রচলিত অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারের মূলোৎপাটন সম্ভব হতে পারে এবং মানুষ মনোরোগের কষ্ট থেকে রক্ষা পেতে পারবে। এছাড়া যারা সমাজের মঙ্গলকামী, সমাজসেবী নারী-পুরুষ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই মানসিক রোগ সচেতনতামূলক কাজে অংশ নিতে পারেন।

মানব সভ্যতার সবচেয়ে পুরাতন রোগ মানসিক রোগ। সভ্যতার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্নভাবে মানসিক রোগকে চিহ্নিত করা হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখার মধ্যে মানসিক রোগের উপসর্গ পাওয়া যায়। বর্তমান পৃথিবীর গবেষণায় নিত্যদিন নতুন নতুন মানসিক রোগের ওষুধ আবিষ্কার হচ্ছে। এখন মানসিক রোগ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে সহজ এবং বেশি নিরাময় যোগ্য। পূর্বে যেমন ধারণা ছিল পরিবেশ, সামাজিক কারণ, বংশানুক্রমিক ইত্যাদি কারণে মানসিক রোগ হতে পারে। কিন্তু' আজকের গবেষণায় এটুকু বোঝা যায় যে, অর্থনৈতিক পারিপার্শ্বিক, বংশানুক্রমিক ইত্যাদি ব্যাপারগুলো এতটা মূল্য নেই। তবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের কারণে মানসিক রোগ হয়ে থাকে। জনসাধারণ সাধারণ কতকগুলো উপসর্গ জানতে পারলে, বুঝতে পারলে, মানসিক চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত হবে। 
পৃথিবীর যে কোন দেশে যে কোন সমাজে নারী পুরুষ নির্বিশেষে, যে কোন ধরনের প্রকার ভেদে মানসিক রোগ হতে পারে। তবে বয়স অনুযায়ী এবং লিঙ্গ অনুযায়ী মানসিক রোগের ধারণাটা একটু আলাদা হতে পারে। আমাদের দেশে অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং দক্ষ জনশক্তির অভাব আছে বলেই আমরা সঠিক চিকিৎসা সঠিক সময়ে প্রয়োগ করতে পারি না। জনসাধারণের মধ্যে মানসিক রোগের চিকিৎসা নেবার ইচ্ছা কম দেখা যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য কাকে বলে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞার অনুযায়ী স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য ও ধর্মীয় স্বাস্থ্যকে বুঝানো হয়েছে। শারীরিক স্বাস্থ্য মানে নিরোগ শরীর আর মানসিক স্বাস্থ্য যেমনে নিরোগ মন। নিরোগ শরীর যেমন প্রয়োজন মনের তেমন প্রয়োজন। আমরা সবাই যেমন সুন্দর শারীরিক স্বাস্থ্য অধিকারী হতে চাই তেমনি হতে চাই সুন্দর মন-মানসিকতার অধিকারী হতে।
অন্য আর দশটি রোগের মত এই রোগ যে কোন সময় যে কোন লোকের হতে পারে। এতে জোক, হেয় বা ঠাট্টা মস্করা বা হেয় করে দেখার কিছু নেই। কেউ যদি ডায়বেটিস আক্রান্ত হয় তাহলে তা সদম্ভে তা বলতে পারি ;
কিন্তু  মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে আমরা লজ্জাবোধ করি। এ জন্য আমাদের মানসিকভাবে পরিবর্তন প্রয়োজন। তা না হলে বিরাট এক জনগোষ্ঠী চিকিৎসা সুবিধা বঞ্চিত হবে এবং তারা ভুগতেই থাকবে। 
----------------------------------------------------------

মানসিক রোগী আর জিনে ধরা রোগীর মধ্যে পার্থক্য কী?


আধুনিক বিজ্ঞানে জিন বা অলৌকিক কোনো শক্তি আছে বলে এমন কোনো আলোচনা নেই। জিনে ধরা বলতে আমরা যেমনটা লক্ষ্য করি এটি সম্পূর্ণ মানসিক ভারসাম্যহীনতা বলে আখ্যায়িত করেছে বিজ্ঞান। তারপরও কিছু বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে কয়েকটি বিষয় আবিষ্কার করেছেন। তারা জিনে ধরা রোগী আর মানসিক রোগীর মাঝে কিছুটা সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। যেমন :
- জিনে-ধরা রোগী কিছুক্ষণের জন্য বেহুশ হয়ে যায়। মানসিক রোগী বেহুশ হয়ে পড়ে না।
- কখনো কখনো জিনে-ধরা রোগীর মুখ থেকে ফেনা বের হয়। দাতে খিল লেগে যায়। মানসিক রোগীর মুখ থেকে ফেনা বের হয় না।
- জিনে ধরা রোগী প্রায়ই স্বপ্নে সাপ, কুকুর, বিচ্ছু, বানর, শিয়াল, ইঁদুর ইত্যাদি দেখে থাকে। কখনো কখনো স্বপ্নে দেখে সে অনেক উচু স্থান থেকে পড়ে যাচ্ছে।
- জিনে ধরা রোগীর সর্বদা ভীতু ভাব থাকে। সর্বদা তার ভয় লাগে। মানসিক রোগীর তেমন ভয় থাকে না।
- জিনে ধরা রোগী নামাজ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর যিকির ইত্যাদি পছন্দ করে না। বরং এগুলো তার অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়।
- জিনে ধরা রোগী কখনো কখনো ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন ভঙ্গিতে কথা বলে।
- জিনে ধরা রোগী অধিকাংশ সময় স্বাভাবিক থাকে। মাঝে মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ করে।
- জিনে-ধরা রোগী থেকে অনেক সময় আশ্চর্যজনক বিষয় প্রকাশ হয়ে থাকে। যেমন অল্প সময়ে সে বহু দূরে চলে যায়। গাছে উঠে সরু ডালে বসে থাকে ইত্যাদি।
- জিনে ধরা রোগীর কাছে স্বামী, ঘর-সংসার, স্ত্রী-সন্তানদের ভাল লাগে না।
- জিনে ধরা রোগীর উপর যখন জিন চড়াও হয় তখন ক্যামেরা দিয়ে তার ছবি তুললে ছবি ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট হয়। স্পষ্ট হয় না। দেখা গেছে আশে পাশের সকলের ছবি স্পষ্টভাবে উঠেছে কিন্তু রোগীর ছবিটি ধোয়াচ্ছন্ন। এটা কারো কারো নিজস্ব অভিজ্ঞতা। মনে রাখতে হবে অভিজ্ঞতা সর্বদা এক রকম ফলাফল নাও দিতে পারে।