Wednesday 21 November 2012

আপনি কি একজন সিজোফ্রেনিয়াক?


সিজোফ্রেনিয়া একটি তীব্র মাত্রার জটিল মানসিক ব্যাধি এটিকে বলতে পারেন গোপন ঘাতক ।এটিকে এক-দু লাইনে সংজ্ঞায়িত করতে মেডিকেল গবেষকরা পর্যন্ত হিমশিম খেয়ে যান। তাই সিজোফ্রেনিয়াকে সংজ্ঞায়িত করার ব্যাপারটিকে অনেকে কৌশলে এড়িয়ে চলেন। এ তীব্র জটিল মানসিক অসুখটিতে মস্তিষেকর স্বাভাবিক কার্যকলাপ যথেষ্ট বিঘ্নিত হয়, যাতে করে সিজোফ্রেনিকরা তাদের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনে ও তাদের দৈনন্দিন ব্যক্তিজীবনে পর্যন্ত বিপর্যস্ত ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। এদের চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি, কাজকর্ম বাস্তবতার সাথে কেমন যেন খাপছাড়া। সিজোফ্রেনিকরা নিজস্ব মনোজগত ভুবন তৈরি করে নেয়, যার মাঝে বাস্তবতার লেশমাত্র নেই।
বাস্তবতার সাথে তাদের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি আর বোধশক্তির এত বেশি ফারাকের জন্যই এটিকে আমরা সাইকোসিস বলে থাকি। সাইকোটিক রোগীরা তারা নিজেরা যে অসুস্থ সেটি পর্যন্ত বুঝতে পারে না



জনপ্রিয় একটি বইয়ের। বইটির নাম হলো ""‘দি ব্রোকেন ব্রেন’""। বাংলা করলে দাঁড়ায় ভাঙা মস্তিষক বা যে মস্তিষক অনেকগুলো টুকরোতে বিভক্ত। সিজোফ্রেনিয়াতে আসলে মানব মন মস্তিষক ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ডা. ন্যান্সি অ্যানড্রেমন অবশ্য বলেন যে, সিজোফ্রেনিয়ার জন্য কোনো একক কারণ দায়ী নয় বরং এ অসুখটি বিকাশের জন্য অনেকগুলো ফ্যাক্টর বা কারণ দায়ী। এতে ব্রেনের বা মস্তিষক গঠনেও পরিবর্তন লক্ষণীয়। এটি বিকাশের পশ্চাতে বংশগত বা জেনেটিক কারণকে অস্বীকার করারও উপায় নেই। এমনকি ভাইরাসজনিত ইনফেকশন বা ভাইরাল সংক্রমণ অথবা মস্তিষেক আঘাতের কারণে যে সিজোফ্রেনিয়া হবে না এমনটিও নিশ্চিত করে বলা যায় না।


আসুন মানব মস্তিষককে আমরা টেলিফোন সুইচ বোর্ডের সাথে তুলনা করে সিজোফ্রেনিয়া সম্পর্কে সপষ্ট একটি ধারণ নেয়ার চেষ্টা করি। সুস্থ মস্তিষেকর সুইচিং সিস্টেম খুব ভালো কাজ করে। এতে নানান ধরনের সংবেদী তাড়না বা খবর আসে এগুলো কোনো রকম তথ্য ঢোকায়। ব্রেনে বা মস্তিষেক তথ্যসমূহের সঠিক প্রক্রিয়াজাত হয়ে থাকে-ফলে ব্যক্তির চিন্তা, চেতনা, অনুভূতি ও সার্বিক কার্যাবলি সুন্দরভাবে প্রকাশিত হয়।

সতর্কতা উদ্রেককারী লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ

##ঘুমের সমস্যা, অনিদ্রা, ঘুম আসতে সমস্যা, ঘুম বারবার ভেঙে যাওয়া, রাত অনেক বাকি থাকতে ঘুম ভেঙে যাওয়া এবং আর ঘুমাতে না পারা। দিনে বা রাতে অনিয়মিত চক্রে ঘুমানো (যারা মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে তাদের বেলায় এমনটি হতে পারে)
##সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া। নিজেকে পৃথক কিছু ভাবা বা বেশির ভাগ সময় একা একা কাটানো
##মানুষের সাথে সামাজিক আন্তঃসম্পর্কে ক্রমশ অবনতি ঘটা
কখনো খুব বেশি কর্মতৎপরতা বা কখনো একেবারে কর্মহীন থাকা এবং এ দুটি ব্যাপার ঘুরেফিরে আসা
##চরম শত্রুতা, ভয়ভীতি অথবা সবকিছুতে সন্দেহপ্রবণতা
কোনো কিছুতে মনোযোগ দিতে না পারা বা মনোনিবেশ করতে সমস্যা
##বন্ধুত্বে বা ভালোবাসায় অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়ান্বিত হওয়া বা পারিবারিক অসমমতি
##নিজের ব্যক্তিগত যত্ন না নেয়া বা নিজের প্রতি খেয়াল না রাখা
সব সময়ই সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা
##কোনো কারণ ব্যতিরেকে পরিবারে অনেক বিষয় লুকানো বা প্রকাশ না করা
##অপ্রকৃতিস্থ আবেগজনিত প্রতিক্রিয়া
##বিমূর্ত কোনো কিছু বারবার লেখা ও শিশুর মতো অসপষ্ট আঁকিবুঁকি করা
আবেগহীন মুখাবয়ব বা চোখে-মুখে আবেগের প্রকাশ না থাকা
##এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, চোখের পাতা না ফেলা বা অহেতুক বারবার চোখের পাতা ফেলা
##শব্দ বা আলোকের প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা বা সপর্শকাতরতা
অদ্ভুত শব্দ বা ভাষায় কথা বলা
##অপ্রকৃতিস্থ আচরণ যেমন পরিচিত কাউকে গায়ে সপর্শ করতে না দেয়া, বারবার মোজা পরা ও খোলা, বারবার শেভ করা, নিজেকে নিজে কোনো কিছু দিয়ে আঘাত করে কষ্ট দেয়া। 

ওপরে যে মানসিক রোগের কতক উপসর্গ বা লক্ষণ প্রকাশ করলাম তার মানে কিন্তু এই নয় যে, এর দু-একটা উপসর্গ কারো থাকলে সে বুঝি মানসিক রোগী। তবে কারো যদি একগুচ্ছ উপসর্গ থাকে, তবে বুঝতে হবে তিনি মানসিক অসুস্থতার ঝুঁকির সমমুখীন অর্থাৎ তিনি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছেন

রোগী আক্রমণপ্রবণ হয়ে উঠলে বা সংকটকালীন অবস্থায় কী করবেন?

আমরা আগেই উল্লেখ করেছি যে, সিজোফ্রেনিয়া একটি বড় মাত্রার মানসিক রোগ। এ অসুখটিকে ওষুধ খেয়ে নিয়ন্ত্রণে না রাখলে তাতে বাস্তবতার সাথে রোগীর তেমন কোনো সম্পর্ক থাকে না। এটিকে সাইকোটিক এপিসোড বা ক্রাইসিস বলা হয়ে থাকে। সাধারণত রোগের লক্ষণ প্রকাশের ১ বছরের মধ্যে চিকিৎসা না করালে রোগী এ দশায় আক্রান্ত হতে পারে।
মানসিক সংকটকালীন বা সাইকোটিক দশায় মানসিক ভারাক্রান্ত রোগী যে উপসর্গ বা আচরণ করে তা হলো-
##হ্যালুসিনেশন (অলীক প্রত্যক্ষণ, গায়েবি আওয়াজ ইত্যাদি)
##ডিলিউশন (ভ্রান্ত বিশ্বাস)
##চিন্তাধারার পরিবর্তন বা বিকৃত চিন্তাধারা
##আচরণ ও আবেগজনিত প্রকাশে অসামঞ্জস্যতা
সিজোফ্রেনিয়ার রোগী যখন এই সংকটকাল অতিক্রম করে তখন পরিবারের সদস্যরা প্রায়শ ঘাবড়ে যান বা তারা বুঝতে পারেন না ঠিক কী করা উচিত। তবে একটি ব্যাপারে আপনাকে বুঝতে হবে, রোগী এ সময়ে যে হ্যালুসিনেশন বা গায়েবি আওয়াজ শোনে তা তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সিজোফ্রেনিকরা সাধারণত যে গায়েবি আওয়াজ শোনে বা অলীক প্রত্যক্ষণ করে তা মানে ও বিশ্বাস করে-এখানেই যত বিপত্তি। হয়তো সিজোফ্রেনিক কানে শুনতে পেল যে, পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পড়- আপনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই রোগী পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে। রোগী হয়তো চোখের সামনে জানালায় অনেক সাপ দেখে খুব ভয় পেয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে অবশ্যই দ্রুততার সাথে চিকিৎসা সেবা নিতে হবে অর্থাৎ রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে হবে। নিচের নিয়মগুলো আপনাকে সংকট উত্তরণে সহায়তা করবে

চিকিৎসা
সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা একটু দীর্ঘমেয়াদি। রোগীকে মেডিকেশন বা ওষুধ নিয়মিত সেবন করাতে হয়। অনেকের বেলায় সহায়তাকারী বা সমর্থনমূলক কাউন্সিলিং করা হয়। অবশ্য অনেক রোগীর ক্ষেত্রে পুনর্বাসন চিকিৎসার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। রোগীকে বাসায় রেখে বা হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করাবেন কি না তা মূলত রোগটির তীব্রতার ওপর নির্ভর করে। তাই সিজোফ্রেনিয়া রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে বা পরিবারের সদস্যকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে।
মেডিকেশন বা ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা
যেসব সিজোফ্রেনিয়ার রোগী অসুখটির সুনির্দিষ্ট উপসর্গে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে নিউরোলেপটিক বা অ্যান্টিসাইকোটিক (মনোবিকারবিরোধী) ওষুধ খুবই কার্যকরী। এগুলো সেবনের কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহের ভেতর রোগীর সুনির্দিষ্ট উপসর্গ যেমন গায়েবি আওয়াজ, অলীক প্রত্যক্ষণ, ভ্রান্ত বিশ্বাস ইত্যাদি কমতে শুরু করে। কতক রোগীর বেলায় এগুলো কমতে মাসাধিককাল লাগতে পারে। 
### ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ইসিটি)-এটিতে মূলত রোগীকে অ্যানেসথেসিয়ার মাধ্যমে অজ্ঞান করে মাথায় কতগুলো ইলেক্ট্রোড স্থাপন করে উচ্চমাত্রার ভোল্টেজ দিয়ে রোগীকে শক দেয়া হয়। এই সময় রোগীর মুখের মাংসপেশিতে খিঁচুনি হয়ে থাকে। সিজোফ্রেনিয়ার কতক রোগী এই থেরাপিতে বেশ উপকৃত হয়ে থাকে। ইসিটি মূলত প্রয়োগ করা হয় তীব্র বিষণ্নতার রোগীদের ক্ষেত্রে। অবশ্য ম্যানিক ডিপ্রেসভ সাইকোসিস বা যাদের মন-মেজাজের খুব বেশি পরিবর্তন হয়ে থাকে তাদের ক্ষেত্রেও এটি নির্দেশিত।
@@@@ পুষ্টি দিয়ে চিকিৎসা: অনেক সময় সিজোফ্রেনিয়া রোগীর ভিটামিন ‘বি’-এর অভাব থাকে। ডা. এইচ অসমন এই সম্পর্কে একটি থিওরি দিয়েছিলেন যাকে মেগাভিটামিন থিওরি বলে। এতে মূলত নিয়াসিন বা ভিটামিন বি৩ রোগীকে প্রচুর পরিমাণে সেবন করানো হয়। বর্তমানে এটি তেমন প্রয়োগ করা হয় না


তাই আসুন নিজেকে জানি, নিজের সমস্যা নিজেই বুঝি, কোনো সমস্যা হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেই। মনে রাখবেন সাইকোলজিস্ট এর কাছে যাওয়া মানেই পাগল হওয়া নয় । 


তথ্যসুত্র-সাইকোলজিকাল জার্নাল ও ইন্টারনেট। 

No comments:

Post a Comment