Wednesday 12 February 2014

গাঁজার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:-গাঁজার অভিশাপ এবং মানসিক রোগ


গাঁজাকে বলা হয় 'গেট-ওয়ে ড্রাগ', অর্থাত্‍ নেশায় হাতেখড়ি হয় গাঁজার মাধ্যমে৷ গাঁজা নিয়ে গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলো সচেতন/অসচেতন পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরার জন্য এ অব্যার্থ প্রয়াস। 

গাঁজা বাংলাদেশে বহুল পরিচিত মাদকদ্রব্য যার বৈজ্ঞানিক নাম ক্যানাবিস স্যাটিভা ৷ পৃথিবীর অধিকাংশ উষ্ণমন্ডলীয় এলাকায় গাঁজা অধিক পরিমানে জন্মে৷ এর বিচি পশুখাদ্য হিসেবে, এর কান্ড শণের দড়ির ভাল তন্তু হিসেবে এবং তেল রঞ্জক পদার্থের উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়৷ আর গাঁজা-উদ্ভিদের বীজ, তৃণ ও আগাছা সহ শুষ্ক অংশ নেশার দ্রব্য যা গাঁজা (মারিজুয়ানা) হিসেবে
ব্যবহৃত হয়৷ গাঁজা উদ্ভিদের ফুলযুক্ত ওপরের অংশ ও পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে যে নির্যাস পাওয়া যায় তার সাথে উদ্ভিদজাত তেল মিশিয়ে তৈরী করা হয় হাশিশ বা চরস৷ গাঁজা উদ্ভিদের পাতা ও ডাল পালা থেকে আহরিত হয় গাঢ় সবুজ ও গাঢ় বাদামী রস বা ক্যানাবিস তেল৷ আর এই সবগুলিই ব্যবহৃত হয় মাদকদ্রব্য হিসেবে৷গাঁজার মূল নেশা উদ্রেককারী উপাদান হচ্ছে ডেল্টা-৯-ট্রেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল৷এই টিএইচসি-র পরিমানই ব্যবহারকারীর নেশার অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ 

বাংলাদেশে গাঁজা 
বিশ্বের অপরাপর দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কোন কোন অঞ্চলে স্মরণাতীত কাল থেকে গাঁজার চাষ হতো বলে জানা যায়৷ নওঁগা জেলায় সমবায় সমিতির মাধ্যমে সরকারী নিয়ন্ত্রণে গাঁজার চাষ হতো ক'বছর আগেও৷ ওখান থেকে সংগ্রহ করে গাঁজা বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে 
পৌছে যেতো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গঞ্জিকাসেবীদের কাছে ৷ বাংলাদেশে ১৯৮৯ সালে গাঁজার উত্‍পাদন ও বিপণনের ওপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়৷ 

গাঁজা কিভাবে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে ? 
বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন যে, গাঁজা সেবনের পরপরই টিএইচসি ফুসফুসের মধ্যে দিয়ে শোধিত হয়ে রক্তপ্রবাহের সাথে মিশে শরীরের বিভিন্ন অংশে তথা মস্তিষ্কেও প্রবাহিত হয়৷ মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের কতগুলো সুনির্দিষ্ট স্থান যা ক্যানাবিনয়েড রিসেপটর নামে পরিচিত যার সাথে টিএইচসির সংযোগের ফলে ঐ কোষগুলি প্রভাবিত হয়ে ব্যক্তির আনন্দানুভূতি, স্মৃতি, চিন্তা, মনোযোগ, সংবেদন, সময় জ্ঞান এবং চলাচলের সমন্বয়ের 
ক্ষেত্রে সরাসরি পরিবর্তন আনে যা ১ থেকে ৩ ঘন্টা স্থায়ী হয়৷ যদি গাঁজাকে খাদ্যের সংগে বা পানিতে গুলিয়ে নেয়া হয় তবে এর প্রভাব ধীরে ধীরে - সাধারণত: আধাঘন্টা থেকে এক ঘন্টা পরে শুরু হয় এবং তা ৪ঘন্টার অধিক স্থায়ী হয়ে থাকে৷
গাঁজা সেবনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেবনকারী ব্যক্তির হৃত্‍কম্পন বেড়ে যায়৷ কোমনালীগুলি শিথিল হয়ে বেড়ে যায় এবং চোখের রক্ত প্রবাহের শিরাগুলি স্ফিত হয় যার কারণে চোখ লাল হয়৷ হৃত্‍স্পন্দন স্বাভাবিকের (মিনিটে ৭০-৮০বার) চেয়ে বেড়ে যায় কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং গাঁজা যদি অন্য কোন মাদকদ্রব্যের সাথে নেয়া হয় তবে এর প্রভাব অনেক বেড়ে যায়৷ গাঁজা সেবনের প্রায় পরপরই টিএইচসি ফুসফুসের মধ্য দিয়ে শোধিত হয়ে রক্তপ্রবাহের সাথে মিশে কোষের মেদল অংশের মধ্যে সঞ্চিত হয়৷ তারপর সাধারণত: এক সপ্তাহ বা অনুরূপ সময়ের মধ্যে তা আবার রক্ত প্রবাহের সাথে মিশে যায়৷ মদ এবং ফেনসিডিল এর মতো পানিতে দ্রবণীয় কোন কোন মাদকদ্রব্য শরীর থেকে দ্রুত বেরিয়ে যায়৷ কিন্তু টিএইচসি-র অবশিষ্টাংশ মেদ-কোষে থেকেই যায় এবং এর প্রতিক্রিয়া শেষ না হতেই আরো গাঁজা সেবন করলে ক্রমবর্ধমান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়৷ যত বেশী মাত্রায় গাঁজা সেবন করা হবে - যত বেশী গাঁজা মিশ্রিত মাদক ধূমপান করা হবে - ততবেশী বিভ্রান্তিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে এবং ততবেশী মন ক্রিয়ার ঘাটতি দেখা দেবে৷ 
অল্প মাত্রায় সেবন করলেও সেবনকারীর ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য স্মৃতিভ্রম ঘটে৷ গাঁজা সেবীদের ক্ষেত্রে এইরূপ স্মৃতিভ্রম প্রায়ই ঘটে; তারা একটি সৃজনশীল জটিল বাক্য শুরু করে কখনো তা ভালোভাবে শেষ করতে পারেন না, অসংলগ্ন বা এলোমেলোভাবেই তা শেষ হয়৷ দীর্ঘদিন গাঁজা সেবন করলে বিশেষ করে মাঝে মাঝে অতিমাত্রায় সেবন করলে সেবনকারীর মধ্যে 'মস্তিষ্ক বিকার' কিংবা মনোবিকাররগ্রস্ততা দেখা দেয়, যা উন্মত্ততার শামিল৷ ব্যক্তি ক্রমে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে দৃষ্টি ও শ্রুতিগত হ্যালুসিনেশনে ভোগে৷ কখনো কখনো ব্যবহারকারীর মধ্যে দেহ নিরপে বিচ্ছিন্নতাবোধ অর্থাত্‍ নিজের পরিচিতি সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয় ৷

শারীরিক ক্ষতি : 
কমবেশী মারিজুয়ানা সেবন করলেই 
পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়; তবে প্রায়ই পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় দীর্ঘদিন ধরে সেবন করলে৷এ ক্ষেত্রে যে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তা হলো চোখ ও হাতের সমন্বয়ের দুর্বলতা, যার ফলে গাড়ি চালানো, মেশিনের কাজ ঝু্ঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে৷ প্রজনন অমতা, হৃত্‍স্পন্দন বৃদ্ধিতে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া এবং দৃষ্টি ও সময় অনুধাবনে বিভ্রান্তিজনিত অস্থিরতা, মানসিক বৈকল্য ও অবসাদগ্রস্ততাও দেখা দেয়৷ 

দীর্ঘদিন ধরে গাঁজা সেবনে সবচেয়ে বেশী প্রতিক্রিয়া দেখা যায় শরীরের এন্ডোক্রাইন ক্রিয়া, শ্বসন ক্রিয়া ও রোগপ্রতিরোধ 
ক্ষমতার৷ তামাকের চেয়ে গাঁজা অধিক বিপদজনক কারণ গাঁজা সেবনের সময় সিগারেটের তুলনায় ফুসফুসে অন্তত তিন থেকে চারগুণ বেশী কার্বন-মনোক্সাইড ও অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ জমা হয়৷ সিগারেটে যে পরিমান টার থাকে তার চেয়ে চার পাঁচ থেকে দশ গুণ বেশী থাকে গাঁজায়৷ ফলে গাঁজা সেবীদের ফুসফুসে ও শ্বাসনালীতে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশী৷ গাঁজা সেবনে রোগ প্রতিরোধ মতা কমে যাবার ফলে সেবনকারীর সংক্রামক রোগ বেশী হয় এবং ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসজনিত রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়৷ গবেষণায় দেখা যায় কোন গাঁজা সেবনকারীর সেবনের প্রথম ১ ঘন্টায় হার্টর্এ্যাটাকের ঝুঁকি সাধারণ অবস্থার চেয়ে চারগুণ বেড়ে যায়, কারণ সেবনের ফলে রক্ত চাপ ও হৃদকম্পন বেড়ে যায়; পক্ষান্তরে রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা হ্রাস পায়৷

এই মাদকটি গ্রহনে দৃষ্টিভ্রম, বাচালতা, মাংশপেশীর অনিয়ন্ত্রিত ও অপ্রয়োজনীয় সংকোচন, দিকভ্রান্ত হওয়া, মাথা ঘুরা, ক্ষুধা লাগা, গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে যাওয়া,সময়জ্ঞান হারানো থেকে শুরু করে প্রলাপ বকা, বিকার আসা এমনকি মানুষকে হত্যাকরার ইচ্ছাও জাগ্রত হতে পারে। মাত্রা বেশী হয়ে গেলে অনেক সময় হাত পা এর নড়াচড়ার নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলা, হাতে পায়ে ঝি ঝি ধরা এবং অবশ হয়ে যাওয়া, কথা জড়িয়ে যাওয়া, মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যাওয়া থেকে শ্বাস কষ্ট হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। 


নিয়মিত এবং বেশী মাত্রায় গাঁজা জাতীয় দ্রব্য সেবনে গাঁজা সাইকোসিস (Ganja-psychosis) নামে একধরনের লক্ষন হয়। এতে চোখে রক্তজমে চোখ লাল হয়ে যায়, ক্ষুধামন্দা, নির্জিবতা, শরীরের মাংস-পেশী শুকিয়ে যাওয়া, অত্যাধিক দুর্বলতা, হাত-পা অনবরত কাপতে থাকা, পুরুষত্বহীনতা থেকে শুরু করে পুরোপুরি মানসিক রোগী হয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে।
রানিং এমোক নামক আরেক ধরনের মানসিক বিপর্যয় ও গাঁজা সেবিদের পরিণতি হয়ে আসতে পারে। অবিরত গাঁজা সেবনের কারনে অনেক সময় এদের দৃষ্টিভ্রম, নির্যাতিত-বঞ্চিত হবার কল্পনা থেকে এরা হিংসাত্মক, আগ্রাসি সন্ত্রাসীর ভূমিকায় অবতীর্ন হতে পারে। রানিং এমক হলে লোকটি চোখের সামনে যাকে পায় তাকে তার কল্পিত শত্রু মনে করে অস্ত্র নিয়ে হত্যা করতে পারে এবং এই মানসিক অবস্থা কেটে যাবার আগ পর্যন্ত যাকে সামনে পায় ক্রমান্বয়ে তাকেই হত্যা করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। এই আবেশ কেটে গেলে একসময় সে আত্মহত্যা করতে যেতে পারে অথবা আত্মসমর্পনও করতে পারে।



কিশোরদের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিক্রিয়াসমূহ 

কিশোররা একটি বয়:সন্ধিকাল অতিবাহিত করে বলে স্বাভাবিক পূর্ণতাপ্রাপ্তির জন্য তাদের শরীরে পুরুষ এবং স্ত্রী হরমোন-এর 
ক্ষেত্রে একটি সুস্থ ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন৷ গাঁজা সেবন বয়স্কদের প্রজননতন্ত্রকে তিগ্রস্ত করে এবং কিশোরদের ক্ষেত্রে তা এই তির মাত্রা অনেক বেশী হয়ে থাকে৷ হাড়, শরীর, দাড়ি-গোঁফ, জননেন্দ্রিয় ও কন্ঠ পূর্ণাঙ্গ পুরুষ মানুষের মতো বৃদ্ধি প্রাপ্তির জন্য ছেলেদের ক্ষেত্রে কিশোর অবস্থায় প্রয়োজন স্বাভাবিক পরিমান টেষ্টেটেরন অর্থাত্‍ পুরুষ হরমোন; গাঁজা সেবন করলে ছেলেদের এই হরমোন কমে যায়, পান্তরে, মেয়েদের ক্ষেত্রে টেষ্টেটেরন বৃদ্ধি পায়, যা রজ:চক্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া ব্যাহত করে এবং চর্ম বিষয়ক সমস্যার সৃষ্টি করে৷ 
গাঁজাসেবী কিশোরদের ক্ষেত্রে  আইকিউ হ্রাসের  প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ কয়েকটি পর্যবেণে প্রমাণিত হয়েছে যে, গাঁজা সেবনে চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে৷ স্বল্প সময়ের মধ্যে সাধারণ বিষয় স্মরণ করার মতা হ্রাস পায় এবং পূর্ণমনোযোগ ও জটিল বুদ্ধিভিত্তিক কর্মকান্ড পরিচালনার মতা কমে যায়৷ যেসব কিশোরদের প্রতিদিন স্কুলে নতুন নতুন পাঠ গ্রহণ করতে হয় তাদের জন্য এটি আরও বিঘ্ন সৃষ্টিকারী; কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, গাঁজা গ্রহণের ফলে স্মরণশক্তি ও শেখার ক্ষেত্রে যে বিরূপ প্রভাব পড়ে তা মাদকগ্রহণের পরবর্তী সময়ে প্রায় সপ্তাহ খানেক থাকে৷ এই একই গবেষণা থেকে দেখা যায় যে অনেকদিন ধরে যে সকল ছাত্র গাঁজা সেবন করেছে তাদের সেবন বন্ধ করার পর এক সপ্তাহের মধ্যে একটি শব্দ তালিকা থেকে শব্দগুলোকে সঠিকভাবে স্মরণ করতে চার সপ্তাহ সময় নেয়৷ তবে এটাও লণীয় যে, গাঁজা সেবন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করলে বুদ্ধিবৃত্তিক মতা পুনরায় ফিরে আসে৷ কিন্তু গাঁজাসেবী কিশোর-যুবকদের চিকিত্‍সার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো, অধিকাংশ কিশোর-যুবক বুঝতে পারে না যে, গাঁজা সেবনের ফলে তাদের আচরণের পরিবর্তন ঘটছে৷ এ কারণে তারা যখন গাঁজা সেবন অব্যাহত রাখে তখন তাদের সংশোধন একবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে৷ 
এ সকল কারণে বলা যায়, একটি কম ক্ষতিকর মাদকদ্রব্য হিসেবে গাঁজাকে দেখার যে প্রবণতা সমাজে লক্ষ্য করা যায় তা মোটেও ঠিক নয়৷ অন্যান্য মাদকদ্রব্যের মতোই গাঁজাও ব্যবহারকারীর শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷
সহজলভ্যতা এবং সস্তা হওয়ায় এর প্রচলন ধীরে ধীরে বেড়ে চলতে পারে। সঠিক সময়ে এটা নিয়ন্ত্রন করতে না পারলে গাজার বিষাক্ত শ্বাস এই সমাজের অনেক তাজা প্রানের বিনাশ ঘটাতে পারে।ইদানিং বাংলাদেশের শীশাবারেও শীশার নামে গাঁজা, হেরোইন ও অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্য মেশানো হচ্ছে।  

(সংকলিত)এ সাইফুল-আল-রুবেল

No comments:

Post a Comment