Sunday 18 May 2014

হ্যালুসিনেশন বা গায়েবী আওয়াজ – মানসিক রোগ


‘হ্যালুসিনেশন’ নানা মানসিক রোগের একটা উপসর্গ। মানসিক রোগীরা তাদের কানে নানান ধরনের গায়েবি কথাবার্তা শোনার কথা বলে থাকেন। এটি আসলে হ্যালুসিনেশন। আমরা অনেক সময় ঘুম থেকে জাগার সময় আশপাশের কেউ যেন নাম ধরে ডাকছে এমন মনে করে থাকি। এটিও হ্যালুসিনেশন। এটি হতে অন্তত একটা ব্যাপার সুসপষ্ট- হ্যালুসিনেশন সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থাতেও ঘটতে পারে।  

আমাদের পঞ্চইন্দ্রিয়ের একটা সাধারণ ধর্ম হলো, এরাএক এক ইন্দ্রিয় এক এক অনুভূতি জাগায়। শ্রবণেন্দ্রিয় শব্দের অনুভূতি জাগায়, ত্বক সপর্শানুভূতি জাগায়, জিহ্বা স্বাদের অনুভূতি জাগায়, নাক
গন্ধের অনুভূতি জাগায়, চোখ দর্শনের অনুভূতি জাগায়। আমাদের সামনে যখন কোনো একটা দড়ি ঝুলতে থাকে তখন একে স্বাভাবিক অবস্থাতে দড়ি মনে হবে। যখন কেউ দড়িকে সাপ দেখেন তখন ইলিউশন বা দৃষ্টিভ্রম হয়। দড়ি এখানে একটা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে থাকে। ইলিউশনে উদ্দীপকের দরকার হয়। কিন্তু হ্যালুসিনেশন একদম ভিন্ন প্রক্রিয়া। সামনে কোনো কিছুই নেই অথচ ব্যক্তি কিছু দেখতে পায়। রোগীরা অনেক ক্ষেত্রে বলে থাকে তার সামনে একটা কুকুর হাঁটছে। আশপাশের কেউ তো দেখছে না। রুম তো একদম আলোকিত। তাহলে রোগী কি মিথ্যা বানানো গল্প বলে যাচ্ছে? আসলে রোগীর চোখে হ্যালুসিনেশন ঘটছে।
কিছু ঘটনা হ্যালুসিনেশন নানাভাবে ঘটতে পারে। যাদের পরিবারের কোনো সদস্য সিজোফ্রেনিয়ার মতো কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত তাদের কতক আচরণ হতে এটি বুঝে নেয়া যায়- (১) রহিমা। বয়স ৩০ বছর। প্রচণ্ড কান্নাকাটি করছে। তার সাথে জিন-পরীরা কথা বলে যাচ্ছে। সে সবাইকে দেখতে পাচ্ছে। রোগী আসলে হিস্টিরিয়াতে আক্রান্ত। তার চোখের হ্যালুসিনেশন ঘটেছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন। (২) করিম। ডাক্তাররা তার রোগ নির্ণয় করেছেন ‘সিজোফ্রেনিয়া’। সে সব সময় একা একা কথা বলতে থাকে। আসলে তার একা একা কথা বলাটা হ্যালুসিনেশনের একটা পরোক্ষ প্রকাশ। তার কানে প্রতিনিয়ত নানা গায়েবি আওয়াজ আসে। সে এসব বক্তাবিহীন সংলাপের উত্তর প্রতিনিয়ত দিয়েই চলেছে। তাই তো তার একা একা কথা বলা। (৩) অনেক মানসিক রোগী কানে তুলা দিয়ে থাকেন। কারণ তিনি কোনো এক অজানা জায়গা হতে ভেসে আসা কথাগুলো শুনতে চান না। তাই তো তার এ সতর্কতা অবলম্বন। কিন্তু তাতে কি শেষরক্ষা হবে? এমনও অনেক ঘটনার নজির দেখা গেছে যেখানে রোগী ধারাল কোনো যন্ত্র দিয়ে কানের পর্দা পর্যন্ত ছিঁড়ে দিয়েছে। এতে ফলাফল যা তা হলো রোগী তার কোলাহল বিশ্ব হতে মুক্তি পেয়ে গেলেও এমন এক জগতে তার প্রবেশ ঘটেছে যেখানে বাইরের কোনো শব্দ নেই, কেবল সে সব কথা। তাহলে হ্যালুসিনেশন! 
হ্যালুসিনেশন হলো এমনি একটি দশা-কোনো প্রকার উদ্দীপনা ব্যতিরেকে ব্যক্তি কোনো বিশেষ ইন্দ্রিয়ানুভূতি লাভ করে। এ অনুভূতির সঞ্চার স্বাভাবিক অনুভূতির মতোই ঘটে থাকে। যেমন ধরুন এক ব্যক্তি গায়েবি কথা শুনে থাকে মানে শ্রবণেন্দ্রিয়ের হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। এ গায়েবি কথা খুব হাল্কাভাবে ঘটে থাকে এমন নয় কিন্তু। আশপাশের লোকজনের কথা সে যেমনভাবে শুনতে পায়, কানের গায়েবি কথাও ঠিক তেমনভাবে ঘটে থাকে। হ্যালুসিনেশন দেহের প্রতিটি ইন্দ্রিয়তে ঘটতে পারে।
শোনার হ্যালুসিনেশন কানে গায়েবি আওয়াজ আসাকে বলা হয় শোনার হ্যালুসিনেশন। বেশির ভাগ মানসিক রোগের এটি ঘটে থাকে। রোগী কানে কথা শুনতে পায়। রোগ নির্ণয়ে কেবল এতটুকু তথ্য জানলেই যথেষ্ট নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ এ ক্ষেত্রে কানের গায়েবি আওয়াজের খুঁটিনাটি জিজ্ঞাসা করে থাকেন। কারণ কেবল হ্যালুসিনেশন হতে রোগ নিরূপণ করা যায় না। উল্লেখ্য, হ্যালুসিনেশন ছাড়াও রোগীর আরো নানা উপসর্গ থাকে।
চোখের হ্যালুসিনেশন ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন। রোগী চোখের সামনে কোনো বস্তু দেখতে পায়। এতেও আবার আকারের পরিবর্তন ঘটতে পারে। কোনো বস্তুকে তার স্বাভাবিক আকারের চেয়েও ছোট অবয়বে দেখতে পারে। আবার অনেক বেশি বিবর্তিত হতে পারে। রোগী এ ক্ষেত্রে তার সামনে দৈত্যের কথা বলতে পারে।
ত্বকের হ্যালুসিনেশন রোগী বলতে পারে তার ত্বকের ওপর দিয়ে বা নিচ দিয়ে শুয়ো পোকা চলাচল করছে। অপর একদল বলে থাকে কেউ যেন প্রতিদিন তার সঙ্গে সঙ্গম করে যাচ্ছে। তার শরীরের মাঝে কেউ যেন ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে। এগুলো ত্বকের হ্যালুসিনেশন।
জিহ্বা আর নাসিকার হ্যালুসিনেশন মনোরোগ গবেষকরা এ দুটোকে এক সাথে উল্লেখ করে থাকেন। কারণ এ দুটো নাকি এক সাথে ঘটে থাকে। জিহ্বার হ্যালুসিনেশনে রোগী কোনো এক অজানা জায়গা হতে খাবারের স্বাদ পেয়ে থাকে। নাসিকার হ্যালুসিনেশনে আশপাশের কেউ কোনো গন্ধ শুঁকছে না অথচ রোগী প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে তার নাকে যেন কোথা হতে এক উৎকট গন্ধ আসছে।
ইলিউশন হ্যালুসিনেশন বিস্তৃত আঙ্গিকে বোঝার জন্য ইলিউশন সম্পর্কে একদম স্বচ্ছ ধারণা থাকা চাই। হ্যালুসিনেশন আর ইলিউশন দুটোই বোধনে বিভ্রান্তি। তবে ইলিউশনে কোনো উদ্দীপক থাকবে, হ্যালুসিনেশনে এমন কোনো উদ্দীপক থাকবে না। সামনের ঝুলে থাকা দড়ি যদি কারো কাছে সাপ মনে হয় তাহলে এটি ইলিউশন। যদি কোনো দড়ির অস্তিত্ব ছাড়াই সাপ দেখতে পায় তাহলে তা হ্যালুসিনেশন।
কখন ইলিউশন ঘটে? হ্যালুসিনেশনের মতো ইলিউশনও স্বাভাবিক অবস্থাতে ঘটতে পারে। নানা অবস্থাতে ইলিউশন ঘটে থাকে। এ ধরনের কয়েকটা অবস্থা-
(ক) যখন উদ্দীপন তীব্রতা কমে আসে তখন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষও ইলিউশনের শিকার হতে পারেন। যখন সন্ধ্যায় আলো কমে আসে তখন সামনের ঝোপকে মনে হয় কেউ যেন বসে আছে।
(খ) ব্যক্তির সজ্ঞানতাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যখন কোনো রোগের কারণে আমাদের হুঁশ অবস্থা কমে যায় তখনো এমন বিভ্রান্তি ঘটতে পারে। এ কারণে স্ট্রোক, কিডনি রোগীরা এমনকি জ্বরের রোগী পর্যন্ত এমন বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন।
(গ) ইলিউশন ঘটার ক্ষেত্রে রোগীর মনের অবস্থাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খুব উদ্বিগ্ন অবস্থাতে দূরের ঝোপকে শত্রু মনে হতে পারে।
নানা ধরন আমরা এবার হ্যালুসিনেশন বর্ণনাতে আরো গভীরে প্রবেশ করব। রোগীর কানে গায়েবি কথা আসছে। মানে রোগীর হ্যালুসিনেশন ঘটছে। শোনার এ হ্যালুসিনেশনে নানা রকমারিতা দেখা যায়।
(ক) কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীকে সরাসরি তুমি সম্বোধন করে হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। যেমন তুই শব্দ, তুই এটা কর, তোর সব শেষ…। এ শোনার হ্যালুসিনেশনের নাম সেকেন্ড পারসন হ্যালুসিনেশন।
(খ) কতক ক্ষেত্রে কানে দুই বা ততধিক লোক রোগীকে নিয়ে আলাপ-আলোচনায় মেতে ওঠে। রোগীর অবস্থান অনেকটা থার্ড পারসনের মতো। যেমন করিম ভালো ছেলে, করিমকে দিয়ে কিছু হবে না ইত্যাদি। এর নাম থার্ড পারসন হ্যালুসিনেশন।
(ঘ) কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনের ধরন আরো মজার। রোগী মনে মনে যা চিন্তা করে সেটিই সে শুনতে পায়। কেউ যেন তার মনের মাঝের চিন্তাগুলোকে শুনিয়ে যাচ্ছে। চিন্তাগুলো কথার মাধ্যমে শোনার মাঝেও নানা রকমফের বিদ্যমান। কেউ কেউ মনে চিন্তা আসার আগেই কানে শুনতে পায়, সেটিই পরক্ষণে চিন্তনে রূপ নেয়। অপর দল চিন্তা সমসাময়িকে শব্দ বাক্যে শুনতে পায়। তৃতীয়পক্ষের বেলাতে প্রথমে চিন্তা মনে আসে। অতঃপর মনের সে সব চিন্তা কেউ যেন সশব্দে উচ্চারণ করে শুনিয়ে দেয়। যেন চিন্তাগুলো মনের মাঝে প্রতিধ্বনিত হতে পারে। (ঙ) এক ধরনের শ্রবণ হ্যালুসিনেশন গায়েবি আওয়াজের অবস্থান সার্বক্ষণিক। ক্রিকেটের ধারাবিবরণী প্রকাশের মতো করে ব্যক্তি যেন রোগীর কার্যকলাপ বলেই যেতে থাকে। যেমন করিম ভাত খাচ্ছে, ভাতের সাথে সামান্য তরকারি নিল, তার তরকারি ভালো লাগছে না…। এ ধরনের হ্যালুসিনেশনের নাম রানিং কমেন্টারি।
ঠিক এমনটি ঘটতে পারে শ্রবণ ক্ষমতার বেলাতেও। আমাদের শোনার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিদ্যমান। বাংলাদেশে বসে আমেরিকায় কোনো আত্মীয় কথা বলছে তা শোনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মানসিক রোগে এ অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায় মনের মাঝের কোনো এক অজানা প্রক্রিয়ায়। রোগী তার কাছ হতে হাজার মাইল দূরে থাকা কারো কথা শুনতে পায়। এর নাম এক্সট্রা ক্যাম্পেইন অডিটরি হ্যালুসিনেশন। 
ফাংশনাল হ্যালুসিনেশন এটি আরেক ধরনের মজার শ্রবণেন্দ্রিয় হ্যালুসিনেশন। কেউ হয়তোবা বাথরুমে গিয়ে পানির ট্যাপ ছাড়ল আর সাথে সাথে কানে গায়েবি আওয়াজ আসতে শুরু করে দিল। মজার ব্যাপার হলো যখনই পানির ট্যাপ বন্ধ করে দেয়া হয় তখন সাথে সাথেই কানের শ্রবণেন্দ্রিয় হ্যালুসিনেশন বন্ধ হয়ে যায়।
রিফ্লেক্স হ্যালুসিনেশন ফাংশনাল হ্যালুসিনেশন অপেক্ষা এটি আরো চমৎকার। এরা গান শুধু কানেই শোনে না, তা চোখেও দেখতে পায়। মানে কানের শ্রবণ উদ্দীপনাতে ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন শুরু হয়ে যায়। গাঁজা বা এলএসডি আসক্তিতে এটি দেখা যায়।
অটোসকোপিক হ্যালুসিনেশন এতে ব্যক্তি নিজেকে তার সামনে দেখতে পায় যেন ব্যক্তির সামনে একটা আয়না বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এটি এক ধরনের বিশেষ হ্যালুসিনেশন। এটি পুরোপুরিভাবে চোখের হ্যালুসিনেশন নয়।

বিষণ্নতা রোগে হ্যালুসিনেশন আমাদের সবার ধারণা, হ্যালুসিনেশন কেবল সিজোফ্রেনিয়ার মতো মারাত্মক সাইকোসিসে ঘটে থাকে। অন্যান্য অনেক রোগেও তা ঘটতে পারে। যেমন মৃগীরোগ, বিষণ্নতা, হিস্টিরিয়া এমনকি ব্রেন টিউমারের বেলাতেও।
বিষণ্নতা রোগে মূলত দু’ধরনের হ্যালুসিনেশন ঘটে থাকে। একটা শোনার হ্যালুসিনেশন আর অপরটা দেখার হ্যালুসিনেশন। কানের হ্যালুসিনেশন প্রায়ই ক্ষেত্রে সেকেন্ড পারসন হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। কানে কানে কেউ বলে যায় ‘তুই শেষ’, ‘সামনে তোর মরণ’।
সিজোফ্রেনিয়া রোগেও অনেক ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতে পারে। এ সাধারণ চিত্রে বিষণ্নতার সাথে মূল পার্থক্য হলো বিষণ্ন রোগী কানে ভেসে আসা কথাগুলোকে একদম যৌক্তিক ধারণা করে মাথা পেতে নেয়। সিজোফ্রেনিয়ার রোগী এগুলো শুনে বিরক্ত হয়। এ তো গেল শ্রবণের হ্যালুসিনেশন। আর দেখার হ্যালুসিনেশন ব্যক্তি সামনে দেখতে পায় তাকে সমাধিস্থ করা হচ্ছে।
হ্যালুসিনেশন ও ব্যক্তি যখন কানে গায়েবি আওয়াজ আসতে থাকে তখন ব্যক্তি তাতে কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে থাকে? প্রথমদিকে ব্যক্তি বেশ আতঙ্কিত হয়। সে মনের এসব অনুভূতি বুঝে উঠতে পারে না। এ কারণে অনেকটা বিহ্বল হয়ে চারপাশে তাকাতে থাকে। অনেকে সারাক্ষণ বক বক করে। তারা আসলে কানের আওয়াজগুলোকে প্রশ্ন করে। অনেকে সামনের লোককে আঘাত পর্যন্ত করতে পারে। কারণ হ্যালুসিনেশনে কানে কোনো আদেশ আসতে থাকে। এর নাম কমান্ড হ্যালুসিনেশন।
অধ্যাপক ডা. এ কে এম নাজিদুদ্দৌলা চৌধুরী
এমবিবিএস ডিপিএম এফসিপিএস এমআরসিপি এফআরসিসাইক 
**রানা প্লাজা দূর্ঘটনায় আহত এবং উদ্ধারকারীরা এই হ্যালুসিনেশন বা গায়েবী আওয়াজ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।

No comments:

Post a Comment